পথশিশু থাকলে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় কীভাবে?
সহকর্মী হলেও লিজা বয়সে আমার অনেক ছোট, অনেকটা আমার মেয়ের বয়সী৷ সে বিবেচনায় আমার পরের প্রজন্মের প্রতিনিধি ওরা৷ সেই লিজা আমাকে একটা ঘটনার কথা বলল৷ কদিন আগে, এই রমজানের ঘটনা৷
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এলেও এখনো তারা টিএসসির আড্ডাতে যায় মাঝেমধ্যে৷ সেদিনও গিয়েছিল৷ ওখানেই ইফতারি করেছে৷ বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে৷ উঠতে গিয়ে দেখে, পাশেই একটা গাছের নিচে বসে চার-পাঁচ বছর বয়সের একটা শিশু৷ শিশুটি বসে ছিল খালি গায়ে, কান্না করছিল৷ অশ্রুতে চোখ লাল হয়ে আছে৷ আর সেই চোখজুড়ে জড়িয়ে আছে ঘুম৷ লিজার মায়া হলো, এগিয়ে গেল সে৷ জানতে চাইল, কেন কান্না করছে? শিশুটি বলল, তার খুবই ঘুম পেয়েছে, বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু যেতে পারছে না৷ তার মা তাকে এখানে বসিয়ে রেখে চলে গেছে৷ বলে গেছে- মালাগুলো বিক্রি হলে তাকে এসে নিয়ে যাবে৷ এতক্ষণে লিজার চোখ পড়ল, শিশুটির সামনে থাকা বেশ কয়েকটি বেলি ফুলের মালার দিকে৷ শিশুটির সঙ্গে কথা বলে লিজা জানতে পারল, ওদের বাসা কামরাঙ্গির চরে৷ প্রতিদিন ওর মা ওকে নিয়ে এসে টিএসসির সামনে কয়েকটি বেলি ফুলের মালাসহ বসিয়ে দিয়ে যায়, মালাগুলো বিক্রি হয়ে গেলে রাতে ওকে নিয়ে বাসায় যায়৷ প্রতিটি মালার দাম ১০ টাকা৷ মালা কেনার কোনো দরকার ছিল না, তারপরও লিজা একটা মালা কিনল, শিশুটিকে ১০ টাকার জায়গায় কুড়ি টাকা দিল৷ ওর দেখাদেখি আরও একজন কুড়ি টাকা দিয়ে একটা মালা কিনল৷
ঘটনাটি যখন লিজা আমার কাছে বলছিল, ওর চোখ ছলছল করছিল, কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে আসছিল৷ কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা, ১০ টাকার জায়গায় কুড়ি টাকা দিয়ে লিজা কি ওই শিশুটির কোনো উপকার করল? নাকি তার এই ‘পেশা’টির স্থায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিল? শিশুটির জন্য লিজার মায়া আছে, অন্য আর একজন অচেনা মেয়ের মায়া আছে, আমার মায়া আছে, আর তার মায়ের মায়া নেই? নিশ্চয়ই আছে৷ বরং বলা যায়, আমাদের সকলের চেয়ে অনেক বেশিই মায়া আছে তার৷ কিন্তু যে ঘটনাটি হয়েছে ওই শিশুর ক্ষেত্রে, রাত আটটা পর্যন্ত একটা গাছের নিচে একাকী বসিয়ে রাখা, সেটাকে কি কোনোভাবেই একটা মায়াময় বিষয় বলা যায়? শিশুর চোখের সেই অশ্রু, সেই ঘুমে ঢলে পড়ে অবয়ব-এসব তো আর মিথ্যা নয়৷ একজন মা কেন এমন করেন? অথবা একজন মা-কে কেন এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে হয়?
এটি কিন্তু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ রাস্তাঘাটে চলাচল করার সময় এমন দৃশ্য অহরহই দেখা যায়৷ কেউ ফুল বিক্রি করে, কেউ কলম, আবার কেউ বা গৃহস্থালী কোন জিনিসপত্র৷ ঢাকার রাজপথে যারা চলাচল করেন, যানজটে থমকে থাকেন, এরকম ‘শিশু বিক্রেতা’কে নিয়ে তারা বেশ বিরক্ত বা বিব্রতই বোধ করেন৷ কারণ এরা থেমে থাকা গাড়ির জানালায় টোকা দেয়, কিছু একটা বিক্রির চেষ্টা করে৷ নগরবাসীদের জন্য এসব খুবই পরিচিত দৃশ্য৷ আচ্ছা, এই দৃশ্যগুলো আমাদের মনে কি কিছুটা হলেও আলোড়ন তুলে? আমরা তাকাই, কিন্তু দেখি কি? একটা শিশুর কি এভাবে রাস্তায় থাকার কথা? জিনিসপত্র বিক্রির জন্য ছোটাছুটি করার কথা? এসব কি স্বাভাবিক কোনো দৃশ্য?
শুনতে যতই খারাপ লাগুক, এটাই সত্য যে শিশুদেরকে আমরা স্বাভাবিক জীবন দিতে পারছি না৷ আমরা এদের শৈশবকে নির্লিপ্তভাবে প্রতিনিয়ত হত্যা করে চলেছি৷ এটা আসলে কার দায়? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে বিশেষ কোনো গবেষণার দরকার পড়ে না৷ সহজেই বলে দেওয়া যায়-এই ব্যর্থতার দায় পুরোপুরি রাষ্ট্রের৷ আমাদের রাষ্ট্র পারেনি৷ পারেনি যে, এটা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো দুঃখবোধ বা অপরাধবোধও নেই৷ তারা এটাকে তারা নিজেদের দায়িত্ব বলেও মানতে রাজি হচ্ছে না৷ উল্টো বিষয়টাকে হালকা করার জন্য ‘পথকলি’, ‘পথশিশু’-এরকম নানা বাহারি নামকরণের মাধ্যমে এক ধরনের বাহবা নেওয়ার চেষ্টা করছে৷
কিছুদিন আগের একটা ঘটনা বলি৷ আমি তখন নিউ ইস্কাটনের দিলু রোডে থাকতাম৷ কারওয়ান বাজারের দিকে আসতে কিছুটা পথ রেললাইন দিয়ে আসতে হতো৷ সেই রেললাইনের পাশেই একদিন দেখি কয়েকটি শিশু পিঠে ছালার ব্যাগ নিয়ে ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র কুড়াচ্ছে৷ এদের প্রায় সকলেরই আর এক হাতে একটা পলিথিনের ঠোঙা, তারা কিছুক্ষণ পরপর সেই ঠোঙায় নাক-মুখ লাগিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে৷ একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম-এটা কী করছে? সে কোনো জবাব না দিয়ে অন্য দিকে হেঁটে চলে গেল৷ পাশেই থাকা এক পথচারী জানালেন, এটা একধরনের নেশা৷ নাম-ড্যান্ডি৷ এই নামে পরিচিত হলেও আসলে পলিথিনের মধ্যে থাকা পদার্থটির নাম ডেনড্রাইট অ্যাডেসিভ৷ রাবার বা প্লাস্টিক জাতীয় জিনিস জোড়া লাগাতে এটি ব্যবহার করা হয়৷ এতে এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ থাকে, একটা মাদকতা থাকে৷ নামটা যে আমি জানতাম না, তা নয়৷ তবুও ওই শিশুটির কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম৷ শিশুটি আমাকে পাত্তা দেয়নি৷ বরং তার চোখেমুখে আমার প্রতি একধরনের বিজাতীয় অবজ্ঞা বা আক্রোশ সেদিন আমি দেখেছি৷ ডেনড্রাইট অ্যাডেসিভের এমন নেশায় আসক্ত এখন রাজধানীর ৮৫ শতাংশ পথশিশু৷ এদের বয়স ৭ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে৷ এটি আমার অনুমান নয়, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য৷ কিছুদিন আগে সামাজিক মাধ্যমে একটা ভিডিও দেখলাম, সেখানে তিন কী চার বছরের একটি শিশুও ড্যান্ডির নেশা নিচ্ছে৷ বাচ্চাটি ড্যান্ডির নেশায় ঠিক মত হাঁটতে পারছে না, তারপরও ওই ঘ্রাণটি নেওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছে৷
ড্যান্ডির এই নেশা শিশুদেরকে সমাজ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, নিস্পৃহ করে দিচ্ছে৷ ইদানিং ‘কিশোর গ্যাং’ হিসাবে যারা পরিচিতি পেয়েছে, দেখা যায় তাদের সকলেরই কোনো সুস্থ শৈশব ছিল না৷ পথশিশুদের অনেকেই একটু বড় হয়ে এরকম কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হয়ে পড়ছে৷ ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অবলীলায় অনেক বড় বড় অপরাধ করতে পারছে৷ আমরা শিশুদের খাদ্য দিতে পারছি না, নেশা করতে দিচ্ছি৷ আমরা শিশুদের শৈশব দিতে পারছি না, অপরাধের পঙ্কিলতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছি৷ এর দায় কি কিছুমাত্র রাষ্ট্রের উপর পড়বে না?
ইদানিং ‘উন্নয়ন’ শব্দটির বহুল ব্যবহার দেখা যায়৷ উন্নয়ন যেন তান্ডব আকারে সর্বব্যাপী রূপ ধারণ করেছে৷ যে কোনো প্রশ্নে জবাবেই অবধারিতভাবে এসে যাচ্ছে উন্নয়নের কথা৷ গণতন্ত্রহীনতার জবাবও দেওয়া হচ্ছে ‘উন্নয়ন’ ফিরিস্তি দিয়ে৷ কিন্তু উন্নয়ন বিষয়টা আসলে কী? ইট কংক্রিটের নতুন নতুন রাস্তা, ফ্লাইওভার, সেতু? নাকি সেই রাস্তার পাশে ধুঁকতে থাকা শিশুদের বিবর্ণ উপস্থিতি? সরকার বৃদ্ধদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেছে৷ শুনছি এরপর নাকি সকলের জন্য পেনশনের ব্যবস্থাও করা হবে৷ বৃদ্ধ, প্রবীণদের জন্য সরকারের এমন ভাবনা অবশ্যই ভালো৷ তবে একটা দেশের বা একটা সমাজের, ভবিষ্যৎ কিন্তু নির্ভর করে সেই দেশের শিশুদের ওপর, বৃদ্ধ বা প্রবীণদের ওপর নয়৷ শিশুদের জন্য আমরা কী করতে পারছি?
ওই যে শিশু, মালা বিক্রি করছে বা ড্যান্ডি শুকতে শুকতে ফ্যালনা জিনিসপত্র কুড়াচ্ছে, উন্নত যে কোনো দেশে হলে সেই সরকার কী করতো? এভাবে এই কাজগুলো করতে দিত? আমরা তো শুনি, উন্নত দেশগুলোতে নাকি সন্তানের লালন পালন যথাযথ হচ্ছে না মনে করলে বাবা-মার কাছ থেকে পর্যন্ত শিশুদেরকে নিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকেরা৷ প্রায়ই শুনি, সরকারের লোকদের মুখেই শুনি, আমাদের দেশটা নাকি ইউরোপ, আমেরিকা বা সিঙ্গাপুরের মতো হয়ে গেছে৷ কোন দিক দিয়ে হয়েছে? কল্যাণ রাষ্ট্রের যা দায়িত্ব, তার কত শতাংশ পালন করতে পারছে আমাদের সরকার? যে রাষ্ট্র স্বাধীনতার অর্ধশতক বছর পরে এসেও শিশুদের ন্যূনতম জীবনব্যবস্থাকে নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, সে রাষ্ট্র উন্নয়নের কথা বলেই বা কিভাবে?
অথচ শিশুদের নিয়ে কিন্তু গালভরা শব্দ আর আনুষ্ঠানিকতার অন্ত নেই৷ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চকে সরকার ঘোষণা করেছে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসাবে৷ জাতির জনকের জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসাব স্বীকৃতি থেকে এমনটি মনে করার যথেষ্ট সুযোগ আছে যে, সরকার বুঝি শিশুদের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে৷ কিন্তু বাস্তবে কি তেমন কিছু দেখা যায়? শিশু অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক নীতিমালা, কর্মসূচি, সনদ, ইত্যাদি আছে৷ আন্তর্জাতিক সেসব সনদ বা নীতিমালায় স্বাক্ষরদানকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে৷ দেশে প্রতিবছর ঘটা করে শিশু অধিকার সপ্তাহও পালিত হয়৷ কিন্তু এসবে ফলটা কী হয়? কিছুই যে হয় না, সেটা আর অঙ্ক করে বোঝা লাগে না৷ প্রকৃত প্রস্তাবে ‘পথশিশু’ আর ‘শিশু অধিকার’ বিষয়দুটিই তো বিপরীতধর্মী৷ যে দেশে পথশিশু আছে, সেখানে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় কীভাবে?
মানবাধিকার, নারী অধিকার, সংখ্যালঘু অধিকার—এরকম নানা ধরনের অধিকারের কথা আমরা শুনি৷ এসব অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনও হয়, সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যরাই করে৷ কিন্তু শিশু অধিকারই বোধকরি একমাত্র অধিকার, যা পাওয়ার জন্য শিশুরা কোনো আন্দোলন করতে পারে না৷ তাদের অধিকারটা বড়দেরকে নিশ্চিত করতে হয়৷ তাই শিশুরা যখন অধিকারবঞ্চিত থাকে, তখন তার জন্য বড়দেরকেই দায় নিতে হয়৷ আমাদের বড়রা—যারা বয়সে বড়, ক্ষমতায় বড়, তারা কি সে বিষয়ে সচেতন?