আন্তরিক নয় রাষ্ট্র, মৌলিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত শিশুরা

মিরপুরের হাজীপাড়া বস্তিতে থাকে বাবু। কাজ করে একটি গ্যারেজে, পাশাপাশি ব্র্যাক স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। বাবুর বাবা অসুস্থ, মা অটোরিকশা চালান। বস্তির পেছনে ‘বুইড়ার মাঠে’ তারা খেলাধুলা করত দলবেঁধে। জায়গাটি দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়ায় সেখানে যাওয়ার উপায় রুদ্ধ। দেয়ালঘেরা সেই মাঠের একপাশে আবর্জনার স্তূপ, মাঠজুড়েই জমে থাকা নোংরা পানি।

বাবুর বন্ধু হৃদয়ও একই এলাকার বাসিন্দা। সে পড়ে পাশের উষা স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে। দুই বন্ধুসহ ওই এলাকার অন্য কিশোররাও এই জায়গায় খেলত। এখন সেই সুযোগ না থাকায় মন খারাপ দুজনেরই। তারা জানাল, পাশের এলাকায় একটি মাঠ আছে। তবে সেখানে গেলে ওই এলাকার ছেলেরা ব্যাট-বল কেড়ে নেয়। আবার ছুটির পর স্কুলের গেটও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তাদের খেলাধুলা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

বস্তিবাসী হৃদয় আর বাবু কেবল নয়, মাঠের অভাবে খেলার সুযোগ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার বাস্তবতার সাক্ষী ঢাকা শহরের প্রায় সব শিশু-কিশোর। তাদের একদিকে যখন খেলার সুযোগ নেই, অন্যদিকে তথাকথিত ভালো স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের ওপর রয়েছে পড়ালেখার চাপ। ঢাকার এসব শিশুর বেড়াতে যাওয়ার জন্য নেই পর্যাপ্ত স্থান, নেই বিনোদনের সুযোগ।

এমন বাস্তবতাতেই গতকাল সোমবার (২ অক্টোবর) দেশব্যাপী পালিত হয়েছে বিশ্ব শিশু দিবস। শিশুর অধিকার, সুরক্ষা এবং শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্টদের আরও উদ্যোগী ও সচেতন করতে একইসঙ্গে শুরু হয়েছে শিশু অধিকার সপ্তাহ, যা চলবে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত।

শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, কেবল ঢাকা নয়, সারাদেশেই শিশুরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুস্থ-স্বাভাবিক যে শৈশব তাদের প্রয়োজন, তা থেকে তাদের অবস্থান বহু দূরে। সব মিলিয়ে শিশুদের মানবিক বিকাশের জন্য উপযোগী পরিবেশ একেবারেই নেই। শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে শ্রেণিবৈষম্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণসহ শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ও সরকারের উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। তারা এ বিষয়ে আন্তরিকও নয়।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটি শিশুর মানবিক বিকাশের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার কোনোটিই আমাদের দেশে নেই বা থাকলেও মানা হয় না। শিশুদের মানবিক বিকাশের জন্য তাদের মানসিক সমর্থন দিতে হয়, তাদের কথা শুনতে হয়, তাদের সমস্যা শুনে তা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হয়। এর কোনোটিই আমাদের দেশে মানা হয় না। দ্বিতীয়ত, শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য খেলাধুলা, বিনোদন ও ইতিবাচক তথ্য দিতে আমরা প্রস্তুত না। মানসিক স্বাস্থ্য বলে কিছু আছে— পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউই তা ভাবতে চায় না। এটি ভাবলে প্রতিটি স্কুলে, বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে কাউন্সিলর বা সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হতো। আর সেটি হলে শিশুরা তার কাছে মন খুলে কথা বলতে পারত। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। এর পেছনে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবারই দায়বদ্ধতা আছে।

আমাদের সমাজব্যবস্থায় শিশুকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে মনে করা হয় না উল্লেখ করে নাসিমা আক্তার জলি বলেন, এ কারণে শিশুর চাওয়া, না চাওয়া, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কিছুই অভিভাবকদের কাছে গুরুত্ব পায় না। মা-বাবা ও অন্য অভিভাবকরা তাদের সব সিদ্ধান্ত শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেন। এমনকি বড় হওয়ার পরও সন্তানদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্তও মা-বাবা নিয়ে থাকেন। এই সময়ে এসে কিছু অভিভাবক সন্তানদের গুরুত্ব দিচ্ছেন, কিন্তু তার হার দুই-তিন শতাংশ বা সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশের বেশি হবে না। সন্তান কী বিষয় নিয়ে পড়বে, তা এখনো আমরা চাপিয়েই দিই। কন্যাশিশুর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা তো বলাই বাহুল্য। শিশুদের কথা ভাবলে এই জায়গাগুলোতে আমাদের অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।

শিশুর সার্বিক বিকাশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার বিভাগের চেয়ারপারসন শান্তা তাওহীদা বলেন, শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন সুষম খাবার প্রয়োজন, তেমনি মানসিক বিকাশের জন্য সুন্দর পরিবেশ প্রয়োজন। সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সমবয়সীদের সঙ্গে খেলা, বয়সোপযোগী সৃজনশীল খেলনা দিয়ে খেলা, বই পড়া, ছবি আঁকা ইত্যাদির সুযোগ প্রয়োজন। কিন্তু শিশুদের আমরা সেই পরিবেশ দিতে পারছি না। তাদের খেলাধুলার জন্য মাঠ নেই, এমনকি অনেক স্কুলেও মাঠ নেই। বাইরের খেলাধুলা বাদই দিলাম, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য খেলনা কিনে দেওয়া বা ছবি আঁকার সামগ্রী কিনে দিতে পারছি কি না, সেটিও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মানসিক বিকাশের সুযোগের আগে দেশের শিশুরা শ্রেণিবৈষম্যের কারণে মৌলিক চাহিদা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের একটি বড় অংশের শিশু দারিদ্র্যের শিকার। তারা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা— এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। এসব শিশুদের অনেকেই শহরাঞ্চলের বস্তিতে বাস করে। অনেকের বস্তিতেও ঠাঁই হয় না। তারা পথশিশু হিসেবে বেড়ে ওঠে, যাদের প্রকৃত অর্থে কোনো ভবিষ্যতই নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজের (বারসিক) এক জরিপেও দেখা গেছে, ঢাকায় চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ রাস্তায় ঘুমায়, যাদের বড় একটি অংশ শিশু-কিশোর। এসব শিশুরা শিক্ষার সুযোগ তো পায়ই না, উলটো নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়। মাদক, ছিনতাই, চুরিসহ নানা কাজে তাদের ব্যবহার করা হয়।

অধিকারবঞ্চিত শিশুদের বিষয়ে বারসিকের সমন্বয়কারী ও গবেষক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল বলেন, ‘রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের বস্তিবাসীদের একটি বড় অংশ মূলত জলবায়ু উদ্বাস্তু। প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে তারা শহরে এসে বস্তিতে ঠাঁই নেয়। তারা নানা ধরনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। শহরাঞ্চলের বস্তিবাসীর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলেও চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তারা ঝরে পড়ে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হার বেশি। মেয়ে শিশুদের ঘরের কাজ বা ছোট ভাইবোনের দেখাশোনায় যুক্ত করা হয়। আর ছেলে শিশুরা অর্থ উপার্জনে যুক্ত হয়ে পড়ে। মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের হারও বেশি। এসব শিশুদের মৌলিক চাহিদাই যেখানে অপূর্ণ, সেখানে মানসিক বিকাশের প্রশ্নই আসে না। সমাজ ও রাষ্ট্রও তাদের দায়িত্ব নেয় না। আর মানবিক বিকাশ দূরের বিষয়, পথশিশুদের মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি নেই।

শিশুদের জন্য রাষ্ট্র কতটা আন্তরিক— জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী আইনজীবী সুলতানা কামাল বলেন, শিশুর বিকাশ পাঁচটি মৌলিক অধিকারের সঙ্গে যুক্ত। এগুলো পূরণ করা না গেলে তার বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হয়। এগুলো একটি মানুষের অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। একটি বৈষম্যমূলক সমাজ আমাদের। কিছু শিশু অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বড় হচ্ছে, আর কিছু শিশু কোনো সুযোগ-সুবিধাই পাচ্ছে না। অনেকে গাছতলায়, বস্তিতে, রাস্তায় বেড়ে উঠছে। এর মধ্যে শিশুরা কীভাবে সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠবে?

এবারের শিশু অধিকার সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, ভবিষ্যতের বিশ্ব গড়ি’। তবে রাষ্ট্র আদৌ শিশুদের জন্য সেই অর্থে বিনিয়োগ করছে বলে মনে করছেন না সুলতানা কামাল।

তিনি বলেন, শিশুর সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যেসব অনুষঙ্গ দরকার, তা আমরা সব শিশুকে দিতে পারছি না। সব শিশুর জন্য মৌলিক অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। কারণ রাষ্ট্র আন্তরিক নয়। মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়ে কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হচ্ছে। রাষ্ট্র আন্তরিক হলে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে না নিয়ে শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার উপযোগী করেই বাজেট করত। এমনকি বাজেটে যতটুকু বরাদ্দ, দুর্নীতির কারণে সেটুকুও শিশুদের কাছে পৌঁছে না। বিভিন্ন ভাতা বিতরণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, প্রকৃতপক্ষে যাদের প্রয়োজন, তাদের কাছে সেই ভাতা পৌঁছাচ্ছে না। যেহেতু এটি একটি বৈষম্যমূলক সমাজ, তাই অনেক শিশুই রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার বাইরে থেকে যায়। আর সেটি ঠিকমতো দেওয়ার জন্য যে কাঠামো, ব্যবস্থাপনা, প্রশাসক বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, সেগুলো নিশ্চিত করার ব্যাপারেও রাষ্ট্র আন্তরিকতা দেখাচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924