ডেঙ্গুতে মৃতদের ২৫% শিশু

দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৪০ জন। এর ২৫ শতাংশই শিশু। মারা যাওয়া ২২ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছর। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া প্রায় অর্ধেকের বয়স ৩০ বছরের নিচে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৩১ জন ঢাকার বাসিন্দা, আটজন চট্টগ্রাম এবং একজন বরিশাল বিভাগের।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শাখার ডেপুটি প্রগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. ইকরামুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের বয়স ১-১৮ বছরের মধ্যে। অন্যদের মধ্যে ১৯-৩০ বছর বয়সের ৯, ৩১-৪০ বছরের আট, ৪১-৫০ বছরের পাঁচ এবং ৫০-৮০ বছরের আটজন রয়েছে।

দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি

দেশে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে।

এ নিয়ে চলতি বছরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৪০-এ। এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরো ৪৬ জন। গতকাল সরকারি ছুটি হওয়ায় বেশির ভাগ হাসপাতাল ডেঙ্গু রিপোর্ট দেয়নি বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে। এ ছাড়া নতুন রোগীসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে এক হাজার ৩৮২ জন।

এর মধ্যে ঢাকার ৫৩টি হাসপাতালে এক হাজার ৭৩ জন এবং ঢাকার বাইরে ৩০৯ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ছয় হাজার ৩৩৯-এ। এর মধ্যে ঢাকায় চার হাজার ৯৩৫ জন এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার ৪০৪ জন।

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু অথবা এক্সটেন্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম নিয়ে রোগী বেশি আসছে। চিকিৎসকের ভাষায়, ডেঙ্গুর চার ধরনের মধ্যে প্রথমবার কোনো রোগী ডেন-১ ধরনে আক্রান্ত হলে পরবর্তী সময়ে সে যদি ডেন-২ বা ডেন-৩-এ আক্রান্ত হয় তাহলে সেটিকে কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু অথবা এক্সটেন্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বলা হয়।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরিন জানান, এবার ডেন-২ ও ডেন-৩-এ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে সমস্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, আগের আক্রান্ত রোগী যদি ডেঙ্গুর নতুন কোনো ধরনে আক্রান্ত হয় তখন নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন—প্রথমবার রোগী যদি ডেন-১-এ আক্রান্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে আবারও ডেন-২ বা ডেন-৩-এ আক্রান্ত হয় তখন জটিলতা তৈরি হয়। এ ধরনের কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গুতে রোগীর সুস্থ হতে সময় লাগে। হাসপাতালে ভর্তি থাকছে পাঁচ থেকে সাত দিন।

তাহমিনা শিরিন বলেন, এখন যেসব কমপ্লিকেশন নিয়ে রোগীরা আসছে তাদের বেশির ভাগই দেরিতে হাসপাতালে আসে। ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। এমনটা করা যাবে না। জ্বর হলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করানো ভালো।

ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। এ মশার বিস্তারের প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে যে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপকতা পেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘এ বছর মাঠ পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত থেকে আমরা যে পূর্বাভাস মডেল তৈরি করছি, সেখানে দেখতে পাচ্ছি, যদি আমরা এখনই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেক খারাপ হবে।’

কবিরুল বাশার আরো বলেন, ‘এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যাকে বলা হয় সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা। একটি মহাপরিকল্পনা যদি এডিস মশা ও কিউলেক্স মশার জন্য আলাদা ১০ বছর ধরে চালাতে পারি, তাহলে হয়তো ধীরে ধীরে মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।’

চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু ৫০ শতাংশ

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নগরের দুটি হাসপাতালে মারা গেছে মোট আটজন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সাতজন এবং বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে একজন মারা যায়। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলতি মাসে পাঁচজন এবং গত জানুয়ারি মাসে তিনজন মারা যায়। এর মধ্যে শিশু চারজন এবং নারী এক ও পুরুষ তিনজন। এই হিসাবে চট্টগ্রামের দুই হাসপাতালে মারা যাওয়া মোট মৃত্যুর মধ্যে শিশু ৫০ শতাংশ, পুরুষ ৩৭.৫ শতাংশ এবং নারী ১২.৫ শতাংশ।

চট্টগ্রামে বছরের প্রথম পাঁচ মাস ২২ দিনে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩৭০ জনের মধ্যে পুরুষ ১৮৮, নারী ৮৬ এবং শিশু ৯৬ জন। মোট আক্রান্তের মধ্যে পুরুষ ৫০.৮ শতাংশ, নারী ২৩.২৪ শতাংশ এবং শিশু ২৫.৯৪ শতাংশ।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশুর আক্রান্তের হারও কম নয়। এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট আক্রান্তের মধ্যে শিশু আক্রান্তের হার ২৬ শতাংশ হলেও মোট মৃত্যুহারে শিশু ৫০ শতাংশ। এটা উদ্বেগজনক। দেখা যাচ্ছে, শিশুরা চিকিৎসার আওতায় আসছে দেরিতে। স্বাভাবিক জ্বর মনে করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেরিতে করা হচ্ছে। শেষ সময়ে হাসপাতালে আনার কারণে অনেকে মারা যাচ্ছে। তাই এই সময়ে অভিভাবকদের ডেঙ্গু নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন থাকতে হবে। অভিভাবকরা অবহেলা করলে চলবে না। শিশুর মৃত্যুর হারে দেখা যাচ্ছে, চারজনের মধ্যে তিনজনই ভর্তির দু-এক দিনের মধ্যে মারা যায়।

শিশুর মৃত্যুর হার বেশি কেন, জানতে চাইলে শিশু বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. বাসনা মুহুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, আসলে অসম্ভব ব্যথা হলে শিশুরা বলতে পারে না। শরীরে রক্তের প্লাটিলেট কমতে শুরু করে। হঠাৎ করে দেখা যায়, ডেঙ্গুর শকে চলে যায়। যদি প্রথম দিকে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের সমস্যা হয় না। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ চিকিৎসার আওতায় আসতে দেরি হলে শিশুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। ওই সময় জরুরি চিকিৎসা করলেও বাঁচানোটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924