প্রাথমিকের শিশু: ব্যাগের ভারে চুরি যাওয়া শৈশব

দূরপাল্লার বাসে কিংবা বিমানে ওঠার সময় খেয়াল করে থাকবেন, খুব বড় আকারের লাগেজ সঙ্গে থাকলে, সেটি বহন করতে শুধু শারীরিকভাবেই কষ্ট হয় না, সঙ্গে মানসিক অস্থিরতাও যোগ হয়।

ব্যাগ হালকা থাকলে মানসিকভাবেও কিছুটা হালকা লাগে। এ কথার যথার্থতা কতটুকু, সেটি আপনি নিজেই মিলিয়ে নিতে পারছেন। আমি বা আপনি এই দুর্দশার কথা অনুভব করতে পারি, অভিযোগ করতে পারি, সহায়তা চাইতে পারি।

কিন্তু প্রাথমিকের এক শিশু প্রতিনিয়ত যে এই বোঝা কাঁধে নিয়ে চলছে, সে কাকে বলবে? অবুঝ শিশু তো ধরেই নিয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। যে অভিভাবক তার ভালো-মন্দের হিসাব রাখেন, সে অভিভাবকই তো এত বড় এক স্কুলব্যাগ তার পিঠে তুলে দিয়েছেন। ব্যাগের ভারে ন্যুব্জ হয়ে, ঘাড় নামিয়ে কুঁজো হয়ে শিশু হয়তো ভেবে চলে, এর নামই বোধ হয় লেখাপড়া, তথাকথিত বড় হওয়া।

‘দেয়ালের ভেতর গর্ত’ থেকে আমরা কি কিছু শিখতে পারি

শিশুদের কোনো সমিতি বা সংগঠন নেই। শিশুরা কথায় কথায় রাস্তা বন্ধ করে স্লোগান দিতে পারে না। এই অক্ষমতার কারণেই হয়তো শিশুদের নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই আমাদের। না হলে হয়তো অনুধাবন করতে পারতাম, একটা স্কুলব্যাগের নিজস্ব ওজনের সঙ্গে যুক্ত হয় টিফিন বক্স, পানির বোতল, সব কটি বিষয়ের বই-খাতা, ক্ষেত্রবিশেষে বাড়ির কাজ বা অঙ্কনের সামগ্রী। এই অতিরিক্ত ভারী ব্যাগ বহনের কারণে হতে পারে শিশুর ঘাড় ও কাঁধের মাংসপেশিতে ব্যথা, হতে পারে মেরুদণ্ডের ক্ষতি, ক্লান্তি, অবসাদসহ বিভিন্ন সমস্যা।

আমেরিকান ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শমতে, স্কুলব্যাগের ওজন শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত এক রায়েও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী স্কুলব্যাগ বহন করতে নিষেধ করা হয়েছে।

মনে হতে পারে, এত সব বই-খাতা নিয়ে ব্যাগের এই ওজন বজায় রাখা কী করে সম্ভব! অথচ পরিকল্পনা হওয়া উচিত, এই ওজন রেখেই কী করে শিক্ষা কার্যক্রম বজায় রাখা সম্ভব, সেটির। প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা খাতা লাগবে, নাকি সব বিষয়ের জন্য একটি খাতা হবে; সব বিষয়ের বাড়ির কাজ এক দিনে দেওয়া হবে, নাকি বিষয়গুলো ভাগ করে সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে দেওয়া হবে; প্রতিটি বিষয়ের বই প্রতিদিন বহন করতে হবে, নাকি হবে না—বিবেচনায় আসতে পারে এ দিকগুলো।

আমরা কি কখনো আমাদের শিশুদের কাছে জানতে চেয়েছি, তারা ভালো আছে কি না? আমরা কি জিজ্ঞাসা করেছি, পিঠের ব্যাগ বহন করতে তাদের কষ্ট হচ্ছে কি না? আমরা কি কখনো খবর নিয়েছি, হোমওয়ার্কের চাপে তাদের খেলতে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে কি না? যদি উত্তরগুলো ‘না’ হয়, তাহলে এই অবুঝ শিশুদের ওপর যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলেছে, তার দায়ভার কি আমরা কেউই এড়াতে পারব?

ভারতের স্কুলব্যাগ নীতি অনুযায়ী, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে একটি খাতা, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বাড়ির কাজ ও শ্রেণির কাজের জন্য দুটি খাতা ব্যবহার করা যাবে। তবে যেকোনো একটি ব্যাগে থাকবে, দ্বিতীয় খাতাটি রাখা হবে স্কুলে। স্কুলে লকার থাকা এবং পাশাপাশি বসা শিশুদের বই ভাগাভাগি করার সুযোগের কথাও এসেছে।

বাড়ির কাজের ক্ষেত্রে, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে সপ্তাহে ২ ঘণ্টা বাড়ির কাজ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো ধরনের বাড়ির কাজ থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন-সমর্থিত নির্দেশিকা হলো প্রতিটি গ্রেডে পৌঁছানোর জন্য সর্বোচ্চ ১০ মিনিটের হোমওয়ার্ক। অর্থাৎ প্রথম শ্রেণিতে ১০ মিনিট; দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২০ মিনিট, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩০ মিনিট ইত্যাদি। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কোনো হোমওয়ার্ক নেই।

শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সমাদৃত ফিনল্যান্ডের স্কুলে হোমওয়ার্ক থাকে খুব সামান্য। বরং সেখানকার স্কুলে শিশুদের জন্য আমুদে পরিবেশ নিশ্চিত করার দিকে জোর দেওয়া হয় বেশি; ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে, বেশ কয়েকটি বিরতি দিয়ে, ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় খেলাধুলার।

বইয়ের বোঝায় চাপা পড়া শৈশব অথবা একালের ‘তোতাকাহিনী’

আমাদের নীতি অন্য দেশের মতো হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের নিজস্ব উপযুক্ত নীতি থাকবে। কথা হলো আমাদের সে রকম নীতি কি আছে? থাকলে সেগুলো কি মেনে চলা হয়? না থাকলে কখন করা হবে?

আমরা কি কখনো আমাদের শিশুদের কাছে জানতে চেয়েছি, তারা ভালো আছে কি না? আমরা কি জিজ্ঞাসা করেছি, পিঠের ব্যাগ বহন করতে তাদের কষ্ট হচ্ছে কি না? আমরা কি কখনো খবর নিয়েছি, হোমওয়ার্কের চাপে তাদের খেলতে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে কি না? যদি উত্তরগুলো ‘না’ হয়, তাহলে এই অবুঝ শিশুদের ওপর যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলেছে, তার দায়ভার কি আমরা কেউই এড়াতে পারব?

একটা শৈশব মানে কি শুধু ভারী ভারী ব্যাগ কাঁধে বহন করে চলা? বাড়ির কাজ করতে করতে চোখ ব্যথা করে ফেলা? শৈশব তো হওয়ার কথা ‘কমলা রঙের রোদ’ গায়ে মাখার, ‘পাকা জামের মধুর রসে’ মুখ রঙিন করার, ‘গাছ-পুকুরের মাছ’ দেখার, ‘কাক-কুহুকের ডাক’ শোনার।

এসব থেকে শিশুকে বঞ্চিত করা মানে কি তার জীবন থেকে শৈশব চুরি করে ফেলা নয়? সে জন্যই হয়তো নচিকেতা দুঃখ করে গেয়েছেন, ‘ভিড় করে ইমারত, আকাশটা ঢেকে দিয়ে, চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনা রোদ! ছোট ছোট শিশুদের শৈশব চুরি করে, গ্রন্থ-কীটের দল বানায় নির্বোধ!’

  • ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: bmmainul@du.ac.bd

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924