শীতে শিশুর শ্বাসতন্ত্রের অসুখ ও তার লক্ষণ

শীতে শিশুরা সর্দিকাশি, জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। মূলত ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে শীতকালে শিশুরা এ ধরনের সমস্যায় পড়ে। শীতে সাধারণভাবে ভাইরাসজনিত গলা ব্যথা ও ভাইরাসজনিত উদরাময়-ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। বিস্তারিত জানাচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী

শিশুর ঠাণ্ডা-সর্দি বা ‘কমন কোল্ড’

শিশুর ঠাণ্ডা-সর্দি বা ‘কমন কোল্ড’ সাধারণভাবে শিশু বয়সের অসুখ, বিশেষত যেসব শিশুর রোগপ্রতিরোধী শক্তি কম। একটি শিশু বছরে প্রায় ছয় থেকে ১০ বার পর্যন্ত ঠাণ্ডা-সর্দিতে ভুগতে পারে। এতে প্রধানত দায়ী হলো ভাইরাস অণুজীবাণু। যেমন—রাইনোভাইরাস, পেরা ইনফ্লুয়েঞ্জা, রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়েল ভাইরাস।

রোগজীবাণু শিশুর দেহে প্রবেশের দু-তিন দিনের মাথায় উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন—নাক থেকে অবিশ্রান্ত সর্দি, শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা, নাসারন্ধ্রের ঝিল্লির ফোলাভাব, হাঁচি, গলা ব্যথা, কাশ ও শিরঃপীড়া।
ইনফ্যান্ট ও অল্প বয়সী শিশুর জ্বর ১০২০ ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। কমন কোল্ড অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ডেকে আনতে পারে; যেমন—কান পাকা অসুখ, সাইনুসাইটিস, গ্ল্যান্ড ফোলা, সাইনাসে ব্যথা ও প্রবল জ্বর। তখন এসব লাঘবে প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে।

ইনফ্লুয়েঞ্জা (ফ্লু)

ফ্লু থেকে যেসব শিশু অ্যাজমা, জন্মগত হার্টের ত্রুটি বা রোগ প্রতিরোধ শক্তিতে দুর্বল, তারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তীব্র কাশি ও বমি দেখা দেয়। নতুন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, ফ্লু ভ্যাকসিন এতে বেশ কার্যকর।

রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি)

গলা ব্যথা, নাক বন্ধ হওয়া এ রোগের উপসর্গ। শিশু কাশি, শ্বাসে শাঁইশাঁই উপসর্গ নিয়েও হাজির হয়।

স্ট্রেপটোকক্কালজনিত ফ্যারিনজাইটিস

গলা ব্যথা এটির প্রধান উপসর্গ। তবে এই গলা ব্যথা ব্যাকটেরিয়া না ভাইরাসজনিত, তা নির্ণয়ে থ্রোট সোয়াব নিয়ে পরীক্ষা করাতে হয়। গলা ব্যথা উপসর্গ শুধু ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে হয়ে থাকে। বেশির ভাগ ভাইরাসজনিত কারণে হওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন থাকে না। কিন্তু ব্যাকটেরিয়াজনিত স্ট্রেপথ্রোট অবশ্যই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই চিকিৎসা করিয়ে নিতে হবে। কেননা এতে বাতজ্বরের মতো জটিলতা থেকে শিশু রক্ষা পায়।

শিশুর নিউমোনিয়া

নিউমোনিয়া : শিশুর ‘দ্রুত শ্বাস হার’ বা বুকের দুধ পানরত বা শান্তভাবে ঘুমানো অবস্থায় যদি শিশুর বুকের নিচের অংশ ভেতরের দিকে দেবে যায়, তবে বুঝতে হবে শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। শিশুর ‘দ্রুত শ্বাস হার’ বলা হয় যদি

♦ দুই মাসের নিচের বয়সে প্রতি মিনিটে ৬০ বা বেশি।

♦ দুই মাস থেকে এক বছর বয়সে ৫০ বা বেশি।

♦ এক থেকে পাঁচ বছর বয়সে প্রতি মিনিটে ৪০ বা তার বেশি থাকে।

 অতি মারাত্মক নিউমোনিয়া

♦ শিশু ভালোভাবে খাচ্ছে না, বুকের দুধ পানে অসমর্থ।

♦ শিশু কেমন যেন নিস্তেজ।

♦ জিব, ঠোঁট নীলচে বর্ণের।

♦ সাংঘাতিক শ্বাসকষ্ট (মাথা দুলে দুলে উঠছে)।

♦ শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্টকর শব্দ শোনা যায়।

চিকিৎসা

মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে ত্বরিত হাসপাতালে পাঠাতে হবে। প্রয়োজনে শিরায়-মাংসপেশিতে অ্যান্টিবায়োটিক, অক্সিজেন, শিরায় স্যালাইন ও মনিটর করতে হবে।

ব্রংকিওলাইটিস

দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে, বিশেষত তিন থেকে ছয় মাস বয়সে এ রোগের প্রকোপ বেশি। ফুসফুসে বায়ু চলাচলের সরু নালিপথ আছে। ব্রংকিওলাইটিসে ফুসফুসে জালিকার মতো ছড়িয়ে থাকা অতি ক্ষুদ্র সরু বাতাস পরিবহনের নালিপথগুলোর প্রদাহ হয়ে থাকে। এটি সাধারণত ঘটে শীতকালে ভাইরাস সংক্রমণের কারণে। অসুস্থ ব্যক্তির হাঁচি-কাশি বা ব্যবহৃত টিস্যু, খেলনা প্রভৃতির মাধ্যমে জীবাণু অন্য শিশুতে দ্রুত ছড়াতে সক্ষম।

উপসর্গ

♦ প্রাথমিক উপসর্গগুলো হলো—নাক বন্ধ ভাব, নাক দিয়ে পানি ঝরা, সামান্য কাশি ও গায়ে জ্বর। এসব উপসর্গ এক থেকে দুই দিন স্থায়ী হয়। পরে কাশির প্রকোপ বাড়তে থাকে, শ্বাসে শব্দ শোনা যায়। মাত্রাভেদে শ্বাসকষ্ট প্রকাশ পায় বিভিন্নভাবে—দ্রুত শ্বাস, উচ্চ হার হৃদস্পন্দন, শ্বাসের সঙ্গে ঘাড় ও বুকের নিচ অংশের মাংসপেশি দেবে যাওয়া, নাসারন্ধ্রের দুই পাশ ওঠানামা করা।

♦ শিশু খুব অস্থির, খিটখিটে, নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ঘুমাতে ও বুকের দুধ পানে অসমর্থ থাকে। ঠোঁট ও নখ নীলচে বর্ণ ধারণ, বমি, পানিস্বল্পতাজনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

চিকিৎসা

♦ বেশির ভাগ ব্রংকিওলাইটিস সাধারণ মাত্রার ফলে বিশেষ চিকিৎসা লাগে না। বেশি বেশি পানীয়, তরল খাবার দেওয়া অল্প পরিমাণে বারবার। ঘরে বিশুদ্ধ বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ। নরমাল স্যালাইন ড্রপস এবং বাল্ব সিরিঞ্জ ব্যবহার করে, খাবার ও ঘুমানোর আগে নাক পরিষ্কার রাখা। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল দেওয়া যেতে পারে।

♦ শ্বাসকষ্ট ও পানিস্বল্পতার লক্ষণ থাকলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

ছোটদের অ্যাজমা

শিশুর দেখা যাওয়া ক্রনিক রোগগুলোর মধ্যে অ্যাজমা বা হাঁপানি অন্যতম। চার বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুদের প্রতি চার থেকে ছয়জনের একজন কমপক্ষে একবার শ্বাসটান অসুখে ভোগে। এমনকি হাঁপানিতে আক্রান্ত অনেক শিশু ব্রংকাইটিসের রোগী হিসেবে বছরের পর বছর ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে থাকে, যা কোনো কাজে আসে না। অ্যাজমা শিশুদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি ঘটে, খুব অল্পসংখ্যক শিশুর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বয়সে এসে রোগ সম্পূর্ণ সেরে যায়। অনেক ক্ষেত্রে পরবর্তী বয়সে আবার দেখা দেয়। ছোটদের অ্যাজমা দুই ধরনের।

এটোপিক বা একসিনট্রিক : এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাপনায় এটি থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। এই প্রকারে শিশুর মা-বাবা বা মা-বাবার দিকে পরিবারের কারো কারো অ্যাজমায় ভোগার ইতিহাস পাওয়া যায়। এটোপিক অ্যাজমার প্রকোপ গরমকালে বেশি থাকে। ধুলাবালি, কুকুর, বিড়াল ও পশুর লোম, ফুলের রেণু, ধোঁয়া, কয়েকটি অ্যালার্জিক ফুড, ফ্রিজের খাবার, কয়েকটি ওষুধ; যেমন—এসপিরিন, বিটা ব্লকার অ্যাজমার সূচনা করতে পারে।

ইনট্রিনসিক অ্যাজমা

সচরাচর শীতকালে এটিই বেশি হয়ে থাকে। বংশগত ধাত থাকে না। বেশি বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে এটিই প্রধান।

রোগ নির্ণয় কিভাবে

♦ বুকে ঠাণ্ডা লেগেই থাকে অনেক দিন ধরে। শ্বাসটান শব্দ শোনা যায়। রাত্রিকালীন কাশি। দৌড়াদৌড়ি, ব্যায়াম, খেলাধুলার পর শ্বাসকষ্ট বা একনাগাড়ে কাশে বা শ্বাসে শাঁইশাঁই শব্দ।

♦ শিশুকে পরীক্ষা করে।

ব্যবস্থাপনা

♦ শিশুদের অ্যাজমার চিকিৎসায় ফলাফল খুব ভালো। যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা শুরু করা গেলে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ শিশু সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়ে যায়। বাকিরা ক্রনিক অ্যাজমা রোগী হিসেবে সারা জীবন ভুগতে পারে।

♦ যেসব কারণে শিশু বারবার মারাত্মক অ্যাজমায় আক্রান্ত হচ্ছে তার উৎস সন্ধান করে যতটা সম্ভব তা এড়িয়ে চলা।

শিশুর শ্বাসতন্ত্রের অসুখে সাধারণ যত্নগুলো

♦ স্বাভাবিক খাবার ও বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় পান।

♦ কাশি লাঘবে তুলসীপাতার রস, নিরাপদ মধু, লেবু মিশ্রিত পানি খাওয়ানো।

♦ বিশ্রাম, লবণ-পানির গড়গড়া।

♦ জ্বর ও শিরঃপীড়া উপশমে প্যারাসিটামল। এসপিরিনজাতীয় ওষুধের ব্যবহার কখনো নয়।

♦ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্র খুবই সীমিত। এগুলো ভাইরাস দমনে সক্ষম নয়।

♦ বেশি বেশি সর্দি ঝরা, চোখ লাল উপসর্গ লাঘবে অ্যান্টিহিস্টামিন মাঝেমধ্যে ব্যবহৃত হয়।

♦ নাক বন্ধ লাঘবে নাকের ড্রপস এবং কাশি উপশমে বাজারে চালু ‘কফ সিরাপ’ কোনো ভূমিকা পালন করে না, বরং ক্ষতিকর।

♦ হাত ধোয়ার বিষয়ে শিশুকে উদ্বদ্ধুকরণ।

♦ ঘন ঘন শ্বাস, শ্বাস-প্রশ্বাস কষ্টকর হলে, খেতে-খাওয়াতে অসুবিধা, শিশু খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে, অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাত্রা ৯২ শতাংশের নিচে নেমে গেলে—এসব লক্ষণ দেখা দিলে অতি সত্বর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *