শিশু-কিশোরদের প্রতি সহিংসতা কেন
দেশের শিশু-কিশোর-অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রজন্মের জন্য আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম-প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ, আচরণগত পরিবর্তনে ভারসাম্য রক্ষায় পর্যাপ্ত সচেতনতামূলক অনুশীলনের প্রচণ্ড শূন্যতা পুরো জাতিকে কোন্ পথে এগিয়ে নেবে তার সত্য, বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ অতীব জরুরি। বিশেষ করে অতিসম্প্রতি যেসব ভয়ংকর অনাচারের বহির্প্রকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে দেশের জনগণ তাতে যারপরনাই উদ্বিগ্ন, আতঙ্কগ্রস্ত।
আইন প্রয়োগের যথার্থ কার্যকারিতা, শিথিলতা, আদালত থেকে অতিসহজে মুক্ত হয়ে আসা ইত্যাদির কূটচাল দ্রুততর সময়ের মধ্যে নৈর্ব্যত্তিক ধারণা-বোধোদয়ে প্রোথিত করা না হলে এর ব্যাপকতা সমাজকে ধ্বংসের তলানিতে পৌঁছে দিতে পারে। জনশ্রুতিমতে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন অগ্রগতির অদম্য ধারায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে অন্ধকারের অপশক্তি পরিচালিত দেশ বিধ্বংসী চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তার দ্রুত তদন্ত অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সৎ, যোগ্য, দক্ষ, চৌকস সদস্যবৃন্দের সমন্বয়ে বিচার বিভাগীয় কমিটির মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র দৃশ্যমান করার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভূত।
সচেতন মহল সম্যক অবগত আছেন সমগ্র বিশ্বজুড়েই শিশুরা যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশেও শিশুরা অনেকাংশে প্রতিনিয়ত এমন কদর্য পরিস্থিতির সম্মুখীন। সম্প্রতি চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় পাঁচ বছর বয়সী শিশু আয়াতকে বর্বরোচিত কায়দায় খুন ও লাশ ছয় টুকরো করে খালে ফেলে দেওয়ার ঘটনা দেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে শিহরিত করেছে।
শিশুর প্রতি এমন বর্বর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত যে কোনো অপরাধ সংঘটনের জন্য শিশুরা খুব সহজেই নাগালে আসে এবং তারা কিছু বুঝে উঠতে পারে না বলে হীনইচ্ছা চরিতার্থে শিশুদের টার্গেট করা হয়। অনেক সময় পরিবারের বড় সদস্যদের শায়েস্তা করতেও অপরাধীরা শিশুদের ‘বলির পাঁঠা’ বানায়। মানুষের দুর্বল জায়গায় আঘাত করার জন্যই এটা করা হয়ে থাকে। এটি এক ধরনের বিকারগ্রস্ত মানসিকতা ছাড়া কিছুই নয়। আবার ব্যক্তি শত্রুতার জেরে শিশুহত্যা বা অপহরণের মতো ঘটনাও ঘটছে।
পরিবারের নজরদারি, সামাজিক শৃঙ্খলা ও অপরাধীদর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। উন্নত দেশে বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কাউন্সেলিং ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশে এখনও সেই ধরনের বহুমুখী কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তবে সামাজিক সচেতনতা, নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমে পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইউনিসেফের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের তথ্যমতে বাংলাদেশে বর্তমানে ৫ কোটি ৭০ লাখের কাছাকাছি শিশু রয়েছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে ১৪ বছরের নিচে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিশু বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ৯ জন বা ৯০ শতাংশ শিশু নির্যাতিত হচ্ছে এবং সপ্তাহে মারা যাচ্ছে ২০ জন শিশু।
উল্লেখ্য, সংস্থাগুলোর দাবি সমসাময়িক বছরগুলোতে শিশুদের সুরক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও সহিংসতা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে শিশু সুরক্ষায় পর্যাপ্ত আইন রয়েছে। সেক্ষেত্রে শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এছাড়া শিশুর উন্নয়ন ও কল্যাণে বিনিয়োগ প্রয়োজন বিধায় জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
সত্যিকারের মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে শিশুদের প্রতি সকল প্রকারের সহিংস-নির্যাতন বন্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সময়ের জোরালো দাবি। ১৭ নভেম্বর ২০২২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ বিভাগ কর্তৃক দেশের শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ওপর করা ২৬টি পৃথক গবেষণার সারসংক্ষেপ উপস্থাপনে জানা যায়, দেশের শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের ওপর চলছে যৌন নির্যাতন। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে তারা অবহেলার শিকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও অনেক কিশোর-কিশোরীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
২৭ মার্চ ২০২২ তারিখ গণমাধ্যমে প্রকাশিত জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদনে ২০২১ সালে দেশে মোট ১ হাজার ১১৭ শিশু ধর্ষণের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে একক ধর্ষণের শিকার ৭২৩ জন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১৫৫ জন, প্রতিবন্ধী শিশু ১০০ জন এবং অন্যান্য ১৩৯ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
সমসূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের তথ্যমতে ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ৩৭০, ২০২০ সালে ১ হাজার ৩৪৬, ২০২১ সালে ১ হাজার ২৩৫ নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় প্রতিবছরই গড়ে ১ হাজার ২৬০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেকই ধর্ষণের। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্যানুসারে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যাও অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি ফোনকল এসেছে। তন্মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪টি, যৌন নির্যাতন ২৬৮টি, ধর্ষণের হুমকি ৩১টি এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি।
একই অভিযোগে ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫ এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি ফোনকল আসে। মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্যমতে দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে আইন করা হলেও নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ কমছে না। এজন্য অপরাধীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থান না দেখে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে প্রশাসনে ছদ্মবেশে অনৈতিক পন্থায় নষ্ট চরিত্রের ব্যক্তিদের নিয়োগ-পদায়নের কারণে এসব ঘটনার অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ফৌজদারি আইনের দুর্বলতায় অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি হয় না। এ বিষয়ে জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বহুলাংশে আইন প্রয়োগে দেশপ্রেম-নীতিনৈতিকতার অভাবে ধর্ষণ মহমারি রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই আইন প্রয়োগে জনতার অংশগ্রহণ ও সামাজিকভাবে ধর্ষকদের ছবি বা পোস্টার এলাকায় এলাকায় ছড়িয়ে দিয়ে এদের চরিত্র স্খলনের বিষয়টি জনসম্মুখে আনা যেতে পারে।
তাদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক না রেখে সামাজিকভাবে সর্বত্র তাদের চলাফেরায় সীমাহীন লজ্জা বা অপমান করে দেশে লজ্জার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে। কারণ, লজ্জার সংস্কৃতির অভাবেই একটি পরিবার নির্লজ্জ হয়ে তার ধর্ষক ছেলে, ভাই ও আত্মীয়দের বাঁচাতে আসে। জাপানে একজন মানুষ সাধারণ লজ্জায় আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। অথচ এদেশে ধর্ষণ করে মিষ্টি খাওয়ানোর অপসংস্কৃতি চালু ছিল।
যেসব পুরুষ এ ধরনের অপরাধ একের পর এক করে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে অপরাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার গোপনীয় যোগসূত্র অনেক ক্ষেত্রে প্রতীয়মান। ফলস্বরূপ পুলিশ ও মেডিক্যাল রিপোর্ট এবং সর্বোপরি বিচার বিভাগ কর্তৃক ন্যায়বিচার পাওয়া সুদূর পরাহত বিষয়ে পরিণত। বিচারহীনতা-সহিংসতার সঙ্গে জঙ্গি-সন্ত্রাসীর পেশিশক্তির সম্পৃক্ততা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা নিরসনে সরকার আইন প্রণয়ন-বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়াও হতদরিদ্রদের বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে লিগ্যাল এইড ফান্ডের মাধ্যমে মামলা চালাতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। পাশাপাশি দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে বসানো হয়েছে নতুন নতুন ট্রাইব্যুনাল। দেশব্যাপী নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সেবাপ্রাপ্তির সুবিধার্থে ২০১৩ সালে ৪৭টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৭টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল স্থাপন করা হয়েছে।
নির্যাতিতদের মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সহায়তাকে বেগবান করতে ঢাকায় ন্যাশনাল ট্রমা সেন্টার এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রিজিওনাল ট্রমা সেন্টার স্থাপিত হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সরকার ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০’, ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন -২০১০’, ‘মানবপাচার (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন -২০১০’, ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২’, ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭’সহ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৩-২০২৫) প্রণয়ন করেছে।
এতদসত্ত্বেও এসব জঘন্য অপরাধের পিছনে যে ধরনের অপশক্তি অতিমাত্রায় সক্রিয় এবং সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে যারা ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে লিপ্ত রয়েছে তাদের মুখোশ উন্মোচন অপরিহার্য। দায়িত্বশীলতা-পেশাদারিত্বের উৎকর্ষতায় এলাকাভিত্তিক জরিপের মাধ্যমে সত্বর এসব দানবরূপী হিংস্র পশুকে চিহ্নিত করে পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে কঠোর আইনের আওতায় আনা সময়ের জোর দাবি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়