শিশুর জীবন রক্ষায় সাঁতার

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বর্ষায় খালবিল, দিঘি ও নদনদী পানিতে ভরে যায়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবী ক্রমেই চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। ফলে বন্যা-খরা তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এ বছর ভয়াবহ বন্যায় দেশের প্রায় ৩৭টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। আমাদের প্লাবন ভূমির বিস্তৃতি ঘটেছে, পাশাপাশি প্রাকৃতিক জলাধার ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। বড় বড় শহরে শিশু-কিশোরদের সঁাতার শেখার জায়গাও সীমিত হয়ে যাচ্ছে। বয়স্কদেরও অনেকের মৃত্যু ঘটছে সাঁতার না শেখার কারণে পানিতে ডুবে।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহার আগে ও পরে পাঁচ দিনে পানিতে ডুবে বিভিন্ন বয়সের শতাধিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু রয়েছে। পানির প্রতি শিশুদের কৌতূহল সবসময়ই বেশি থাকে। বর্যায় গ্রামবাংলার খালবিল যখন পানিতে থইথই করে, তখন শিশু-কিশোররাও মেতে ওঠে জলকেলিতে।

এই পানিই কখনও কখনও হয়ে ওঠে মরণফাঁদ। বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভের (বিএইচআইএস) সর্বশেষ ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রতি ৩০ মিনিটে একটি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। প্রতিবছর এক থেকে ১৭ বছর বয়সি প্রায় ১৬ হাজার শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। এ সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। অন্য যেকোনো কারণে মৃত্যুর চেয়ে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাই এ বিষয়ে সবার আগে দরকার সচেতনতা। প্রয়োজন বিভিন্ন মহলের কার্যকর উদ্যোগ।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) -এর গবেষণায় দেখা যায়, বরিশাল বিভাগের ২৪টি উপজেলায় ৬৭ শতাংশ শিশুরই মৃত্যু ঘটে পানিতে ডুবে এবং তা বাড়ির ১০০ মিটারের মধ্যে। শিশুদের ক্ষেত্রে ৬৩ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটে সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে। এ সময়টায় গ্রামীণ নারীরা ব্যস্ত থাকেন গৃহস্থালি কাজে। কাজের সঙ্গে সঙ্গে শিশুসন্তানকে সামলানো অনেক কষ্টকর। একটু চোখের আড়াল হলেই ঘটে যেতে পারে বড় বিপদ। ঝুঁকিপূর্ণ এ সময়ে শিশুদের মৃত্যু থেকে বাঁচাতে সিআইপিআরবি বরিশাল বিভাগে গড়ে তুলেছে তিন হাজারেরও বেশি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সারা দেশে সাত লাখেরও বেশি শিশুর সাঁতার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সংস্থাটি।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু এক নীরব মহামারি। এই মৃত্যু ঠেকাতে শিশুকে সাঁতার শেখানোর কোনো বিকল্প নেই। সিআইপিআরবি ২০০৫ সাল থেকে শিশুদের সাঁতার শেখার প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুকে সাঁতার শেখানো, যেন পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমে আসে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ শিশুকে সাঁতার শিখিয়েছে। সাঁতার প্রশিক্ষকদের মতে, একটি শিশু যদি ৯০ সেকেন্ড সাঁতার কাটতে পারে বা পানিতে ভেসে থাকতে পারে, তবে সে অনেকটাই আশঙ্কামুক্ত।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীবিধৌত এ জনপদের প্রতিটি বাড়িতে না হলেও বাড়ির আশপাশে পুকুর কিংবা ডোবা রয়েছে। আর খালবিল তো রয়েছেই। পা বাড়ালেই কোনো জলাধার খুঁজতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। একই সঙ্গে আছে প্রায় প্রতি বছরেই বন্যার আঘাত। বন্যার পানি নিচু এলাকায় জমে থাকে কয়েক সপ্তাহ, কখনও বা কয়েক মাস পর্যন্ত। পানির এই সহজলভ্যতা সাঁতার না জানা শিশুদের প্রতিবছর পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ।

পানির ওপর ভেসে ভেসে বিশেষ কৌশলে জলপথ অতিক্রম করার নাম সাঁতার। সাঁতারের উদ্দেশ্য হলো পানিতে না ডুবে ভেসে থাকা। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অভিভাবকদের অসচেতনতা এর জন্য দায়ী। মা যখন নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, এ সুযোগে শিশু আপন মনে পানিতে নামে, আর তখনই ঘটে পানিতে পড়ে যাওয়ার মতো অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা। তাই সাঁতার শেখা প্রতিটি মানুষের জীবন সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি। সাঁতার শেখার উত্তম সময় হলো শিশুকাল। শহরের বা গ্রামের সব বাবা-মায়ের প্রতিটি সন্তানকে সাঁতার শেখানো উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924