করোনা শেষে এক নতুন পৃথিবী (শেষ পর্ব)

বেছে নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, আমরা কি বিচ্ছিন্ন জাতীয়তাবাদ চাই নাকি সব দেশের মধ্যে একতা চাই। মহামারীটি নিজে একটি বৈশ্বিক সমস্যা, মহামারীর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটও একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই বিশ্বের সব দেশের সহযোগিতার মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব।

ভোরবেলা ইতালিয়ান চিকিৎসক মিলানে যা আবিষ্কার করেন তা সন্ধ্যা নাগাদ তেহরানে অসংখ্য জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে। কোন নীতি অনুসরণ করতে হবে তা নিয়ে যুক্তরাজ্যের সরকার যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় তখন তারা কোরিয়ানদের থেকে পরামর্শ নিতে পারে যারা কিনা এক মাস আগেই একই রকম সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন একটি বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং আস্থার মনোভাব।

দেশগুলোর উচিত হবে তথ্যের মুক্ত আদান প্রদানে সম্মত হওয়া, বিনয়ের সঙ্গে একে অপরের পরামর্শ চাওয়া এবং প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের উপর আস্থা রাখা।

চিকিৎসা সরঞ্জাম বিশেষ করে পরীক্ষার কিট এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র উৎপাদন ও বিতরণের জন্য আমাদের একটি বৈশ্বিক প্রয়াস প্রয়োজন।

প্রতিটি দেশ স্থানীয়ভাবে এটি করার চেষ্টা চালাচ্ছে, যেখানে যা পাচ্ছে তাই সংগ্রহ করছে, এর পরিবর্তে একটি সমন্বিত বৈশ্বিক প্রয়াস জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম উৎপাদন এবং তার সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিত করা যেতে পারে।

যুদ্ধের সময় যেমন দেশগুলো প্রধান শিল্পগুলোর জাতীয়করণ করে তেমনি করোনভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনখাতগুলোকে ‘মানবিক’ করার প্রয়োজন পড়তে পারে। অল্প কিছু করোনা রোগীর একটি ধনী দেশ তার মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলো গরীব দেশ- যার অনেক রোগী- সেখানে পাঠাতে সম্মত হওয়া উচিত।

ধনী দেশ এই ব্যাপারে আস্থা রাখবে যে, পরবর্তীতে তাদেরও যদি সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে তখন অন্য দেশগুলো এগিয়ে আসবে।

চিকিৎসা কর্মীদের জন্য একই রকম বৈশ্বিক প্রচেষ্টা বিবেচনা করতে পারি। কম ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলো সবেচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা দেশগুলোতে চিকিৎসা কর্মী পাঠাতে পারে। বিপদে পাশে দাঁড়ানো হলো আবার মূল্যবান অভিজ্ঞতাও অর্জন করা হলো। পরবর্তীতে মহামারী যদি তার কেন্দ্র বদলে ফেলে সেক্ষেত্রে সাহায্যও সে অনুযায়ী প্রবাহিত হবে।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক সহযোগিতা ব্যাপকভাবে প্রয়োজন। প্রতিটি সরকার যদি অন্যকে বাদ দিয়ে শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাহলে শুরু হবে এক বিশৃঙ্খলা; সংকট হবে আরো গভীর। এটাই অর্থনীতির প্রকৃতি। তাই খুব তাড়াতাড়ি আমাদের একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা দরকার।

ভ্রমণের ব্যাপারে একটি বৈশ্বিক চুক্তিতে পৌঁছানো খুব জরুরি। মাসের পর মাস ধরে সব ধরণের আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বন্ধ রাখা অবর্ণনীয় ভোগান্তির জন্ম দেবে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকেও বাধাগ্রস্থ করবে।

অন্তত কিছু মানুষের সীমানা অতিক্রম করাটা জরুরি, যেমন – বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী। এই ভ্রমণকারীদের তাদের স্ব স্ব দেশ আগে ভাগেই স্ক্রিনিং করবে। এ ব্যাপারে দেশগুলো পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। আপনি যদি জানেন যে কেবলমাত্র সতর্কতার সঙ্গে স্ক্রিনিং করা ভ্রমণকারীদের বিমানে উঠার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তবে আপনি তাদের আপনার দেশে গ্রহণ করতে আরও আগ্রহী হবেন।

দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমানে দেশগুলো এই কাজগুলো একেবারে করে না বললেই চলে। একটি সামষ্টিক পক্ষাঘাত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপর চেপে বসেছে। মনে হচ্ছে ঘরে স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন কেউ নেই। কেউ একজন আশা করতে পারতেন যে, সপ্তাহখানেক আগেই বিশ্ব নেতারা একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য জরুরি বৈঠকে বসেছেন। কিন্তু জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর নেতারা এই সপ্তাহে শুধু একটি ভিডিও কনফারেন্স করতে পেরেছেন, যদিও তারা কোন পরিকল্পনা ঠিক করতে পারেননি।

এর আগের বিশ্ব সংকটগুলোতে, যেমন ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট এবং ২০১৪ সালের ইবোলা মহামারীতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব নেতার ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বর্তমান মার্কিন্ প্রশাসন সেই নেতৃত্বমূলক অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তারা তাদের অবস্থান পুরোপুরি পরিষ্কার করেছে, তারা মানবজাতির ভবিষ্যতের চেয়ে আমেরিকার মহত্বের (গ্রেইটনেস) কথা বেশি চিন্তা করছে।

এই প্রশাসন এমনকি তার নিকটতম মিত্রদেরকেই পরিত্যাগ করেছে। তারা যখন ইইউভুক্ত দেশুগুলো থেকে সব ধরণের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে তখন তারা ইইউকে একটা অগ্রিম নোটিশ দেয়ারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি, এই মারাত্মক পদক্ষেপটা নিয়ে ইইউ’র সঙ্গে আলাপ আলোচনা তো দূরে থাক।

নতুন কোভিড -১৯ ভ্যাকসিনের একচেটিয়া স্বত্ত্ব কিনতে একটি জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে ১ বিলিয়ন ডলার দিতে চেয়ে তারা জার্মানিকে কলঙ্কিত করেছে। বর্তমান মার্কিন প্রশাসন যদি হাওয়া বুঝে পাল তোলে এবং একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনা নিয়ে সামনে আসে, তবুও খুব কম লোকই এমন নেতার অনুসরণ করবে, যিনি কখনো দায়িত্ব নেন না, ভুল স্বীকা করেন না, এবং সমস্ত দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সব কৃতিত্ব নিজে নিয়ে নেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে যাওয়া এই শূন্যতা যদি অন্য দেশগুলো পূরণ না করে, তবে বর্তমান মহামারীটা ঠেকানোই যে শুধু কঠিন হয়ে উঠবে তা নয়, এর রেশ আগামী বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককেও বিষিয়ে তুলবে। তবুও প্রতিটি সংকট একটি সম্ভাবনাও বটে। আমরা অবশ্যই আশা করছি যে, এই মহামারীর অভিজ্ঞতা আমাদেরকে বৈশ্বিক অনৈক্যের ভয়াবহ বিপদকে অনুধাবন করতে সাহায্য করবে।

এখন মানব জাতিকে বেছে নিতে হবে। আমরা কি অনৈক্যের পথ ধরে হাঁটবো নাকি সারা বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠা করবো। আমরা যদি অনৈক্য বেছে নেই, তাহলে এটা শুধু আমাদের সংকটকেই দীর্ঘায়িত করবে না বরং ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভয়ংকর কোন বিপর্যয়ের সম্মুখীন করবে।

আর যদি আমরা বৈশ্বিক সংহতিকে বেছে নেই, তবে তা শুধু করোনভাইরাসের বিপক্ষেই নয়, একবিংশ শতাব্দীতে মানবজাতিকে আঘাত করতে পারে এমন ভবিষ্যতের সকল মহামারী এবং সংকটের বিরুদ্ধে আমাদের বিজয় নিশ্চিত করবে।

(সমাপ্ত)

মূল: ইউভাল নোয়াহ হারারি

অনুবাদ: ডা. নাজিরুম মুবিন

চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
[/pl_text]
[/pl_col]
[/pl_row]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924