কেমন কাটবে ফিলিস্তিনি শিশুদের ঈদ

ঈদ মানে আনন্দ। বছর ঘুরে ঘরে ঘরে খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় এই ঈদ। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদের আমেজ শুধু মুসলিমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জাতি-ধর্ম ভুলে সবাই এই উৎসবের অবগাহনে গা ভেজায়। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম পালনের পর সামনে আসে এ উৎসব। ছড়িয়ে পড়ে আনন্দ-উল্লাস। সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা যখন ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার প্রহর গুনছে, তখনও বিশ্বের কিছু জায়গায় চলছে স্বজন হারানোর মাতম অথবা অনাহারের কান্না। ফিলিস্তিন অধিকৃত গাজা তেমনই এক অঞ্চল। যেখানে বাতাসে ভাসে লাশের গন্ধ। যেখানে কংক্রিটের ফাঁকে ফাঁকে রক্তের ছোপ। যেখানে ক্ষুধার জ্বালায় আর্তনাদ করে গোটা উপত্যকা।

ইসরায়েলি বোমায় সেখানে তাসের ঘরের মতো ধ্বংস হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ভেঙে গেছে মসজিদ, গির্জা, শরণার্থী শিবির, পার্ক, হাসপাতাল, ঐতিহাসিক ভবন। বুলেট-বোমার আঘাত আর ক্ষুধায় এবার ঈদ ‘উদযাপিত’ হবে বিষাদগ্রস্ত গাজায়। গাজায় খাদ্যাভাব চরম। বাড়িতে নেই খাবার, নেই পানি। নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই। অনাহারে থাকা লোকজন অপুষ্টি ও পানি শুন্যতার শিকার হয়ে হাসপাতালের দ্বারস্থ। কিন্তু সেখানেও পরিত্রাণের পর্যাপ্ত রসদ নেই। কারও কারও মাথার ওপর ছাদ নেই, শুধুই আকাশ। জীবনের নিশ্চয়তা তো সেখানে দূরের মিনার!

ইসরায়েলের মুহুর্মুহু হামলায় এবার আনন্দহীন ঈদ কাটাবে গাজাবাসী। হাজার হাজার মানুষ নিহত হওয়ার পর এটিই হবে গাজা উপত্যকাবাসীর জন্য প্রথম মুসলিম ধর্মীয় ছুটি। কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলা ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৩ হাজার ২০৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এই দাবি ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের।

ঈদুল ফিতর আসন্ন অথচ গাজা উপত্যকা যেন এখন এক বিরানভূমি। গত রোববার হঠাৎ গাজার দক্ষিণ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেনা তুলে নেয় ইসরায়েল। যদিও গাজার আগ্রাসন থেকে পরিপূর্ণভাবে সরে আসেনি তারা। ঈদে অন্যান্য মুসলিমের মতো ফিলিস্তিনিরাও উৎসবে মেতে থাকে। কিন্তু এবার সেই গল্পের নজরানা অনুপস্থিত। স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়েই তাদের ঈদের দিন শেষ হবে। ধ্বংস হওয়া বাড়িঘর যেন অদৃশ্য মেমোয়ারের মতো মাথাচাড়া দেবে। তবুও ঈদ সামনে রেখে হয়তো তারা আনন্দে মাতার চেষ্টা করবে। বুধবার গাজায় ঈদ উল-ফিতর পালিত হওয়ার কথা। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উৎসবের কোনো আমেজ নেই। তারা কী করবে ঈদের দিন? কেউ কেউ ঠায় দাঁড়িয়ে অন্য দেশগুলোর পাঠানো ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করবে। পরিচয়পত্র হাতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াবে, বিতরণ কেন্দ্রগুলো থেকে দেয়া ত্রাণ পেয়ে হয়তো ক্ষণিক মুহূর্ত ভুলে যাবে স্বজন হারানোর শোক।

কেউ কেউ হামলায় ধ্বংস হওয়া ভবনের সামনে তাজা সবজি বিক্রি করবে, কেউ রাস্তার ধারে জিলাপি। সেখান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে হয়তো ছোট্ট বোনের জন্য ওড়না বা খেলার পুতুল কিনে ঘরে ফিরবে। অথবা মিষ্টান্ন কিছু নিয়ে হাজির হবে ভাসমান বাসায়। ঈদের দিন উপহার পেলে নিশ্চয়ই ছোটো ভাই বা বোনের মুখে হাসি ফুটবে। সেই হাসি আপাত দুঃখ ভোলার উপশম হিসেবে কাজ করলেও করতে পারে।ঈদ সামনে রেখে হাতেই বিস্কিট বানাচ্ছেন দেইল আল বালা শহরের বাস্তুচ্যুত নারীরা। ছিঁড়ে যাওয়া পুরোনো কাপড় সেলাই করে নিচ্ছেন সেখানকার অনেকে। ঈদের দিন পরবেন বলে। কারও কারও বেলায় সেটাও করার সামর্থ্য নেই। ধুলোয় ধূসরিত দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকে নির্জীব বকের মতো। তাদের ঈদ বলতে কিছু নেই।

গাজার এক ফিলিস্তিনি নারী বলেন, বাচ্চাদের জন্য মিষ্টান্ন হিসেবে বিস্কিট বানিয়েছি। কিন্তু ঈদের জন্য জামা-কাপড় নেই। আমার মেয়ে বড় হয়েছে, তার জন্যও কোনো কাপড় নেই। সব ছিঁড়ে গেছে। জামা-জুতা কিংবা ভালো খাবার নয়, হামলা বন্ধ চাই। যুদ্ধ বন্ধ হলেই ঈদের সকল আনন্দ পাবে গাজাবাসী। এক বাসিন্দা বলেন, যুদ্ধে আবার কেমন ঈদ? এখানে কোনো ঈদুল ফিতর নেই, নেই ঈদুল আজহা। আমাদের জন্য ঈদ মানে আগ্রাসনের সমাপ্তি।

এখনও যুদ্ধবিরতির অপেক্ষায় আছে লাখো গাজাবাসী। বিরানভূমিতে অজস্র ফুল ফোটার আশা এখনও তাদের। তাদের আশা, সমাপ্তি হবে যুদ্ধের, আগ্রাসনের। তাহলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচা সম্ভব। যদিও হামলা বন্ধ বা যুদ্ধবিরতির কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। তবুও আমরা বলতে চাই– অত্যাচারের আতঙ্ক নিয়ে কাটানো এই দিনের হোক অবসান। অবসান হোক সকল প্রকার অমানবীয় যুদ্ধের।

“একদিন ঝড় থেমে যাবে
পৃথিবী আবার শান্ত হবে

বসতি আবার উঠবে গড়ে
আকাশ আলোয় উঠবে ভরে
জীর্ণ মতবাদ সব ইতিহাস হবে
পৃথিবী আবার শান্ত হবে..”

গ্রন্থনা: আল মাহফুজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *