এক থেকে দেড় বছর বয়সে শিশুর জীবনযাপন

দেড় বছর বয়স নাগাদ শিশুর মনে প্রতীকী চিন্তার সূত্রপাত হয়। ফলে তার আচরণে আসে নতুনত্ব। সঙ্গে সঙ্গে শিশু বিকাশের নানা ক্ষেত্র অসামান্য বৈচিত্র্যে ভরপুর হয়ে ওঠে।

আগের তুলনায় দৈহিক বৃদ্ধির হার আরও হ্রাস পায়। তার সঙ্গে কমে যায় খিদে। এ সময় অত্যধিক হাঁটাচলাতে ব্যস্ত থাকার কারণে দেহের চর্বি শুকিয়ে যায়। নিচের মেরুদণ্ড সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে থাকে। এসব মিলিয়ে তার পেট বড় দেখাতে পারে। পুরো ২ বছর ধরে ব্রেইনের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে।

বেশির ভাগ শিশু প্রথম জন্মদিন পালনের আগে স্বাধীনভাবে হাঁটতে শেখে তবে কেউ কেউ ১৫ মাস বয়সের আগে তা অর্জন নাও করতে পারে। খুব চটপটে নির্ভয় শিশুটি যেমন আগেভাগে হাঁটতে পারার সম্ভাবনা থাকে, তেমনিভাবে কম তৎপর, ভীরু শিশুটি হাঁটা শেখে দেরিতে। তবে যে শিশু আগে হাঁটতে পারে, অন্যান্য বিষয়েও এগিয়ে থাকবেÑ সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই।

প্রথম দিকে সে হাঁটে টলমলভাবে। অনেকটা জায়গা নিয়ে হেলেদুলে, যেন এক রাজহাঁস যখন হাঁটু বেঁকে যায়, কনুইতে ভাঁজ রেখে স্থির থাকে হাত দুটি, পায়ের আঙ্গুলের দিক নিশানা ঠিক থাকে না। কিন্তু কয়েক মাসে প্র্যাকটিস নিরন্তর চেষ্টাতে টলটলিয়ে চলার ভাবটি কেটে যায়। হাঁটু সোজা থাকে, হাত দুলিয়ে ব্যালান্স আনার সুবিধা খুঁজে পায় সে, এখন থেকে পায়ের আঙ্গুল সঠিকভাবে ভার বহন করতে পারে এবং এখন থেকে ইচ্ছে হলে থমকে যাওয়া, ঘুরে দাঁড়ানো প্রভৃতি ক্রিয়া সম্পাদনে সে সক্ষম হয়ে উঠে। তাছাড়া আগের মতো সে আর যখন-তখন হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় না।

বৃদ্ধির বিকাশ

কোনো বস্তুর কাছে পৌঁছুতে, তা আঁকড়িয়ে ধরা বা মুঠো খুলে জেড়ে দিতে পারার মতো বৃদ্ধিবৃত্তিগুলো এখন প্রায় পরিণত। হাঁটতে পারার সুবিধা অর্জন তাকে আগ্রহ সৃষ্টিকারী দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহারে সুযোগ এনে দেয়। চুল আঁচড়ানো, কাপ হতে পান করা, ভিডিও রেকর্ডারে ক্যাসেট ঢুকানোর মতো কাজগুলো করতে চেষ্টা করে। এ সময়ে মা-বাবা ও ঘরে বড় শিশুদের চালচলন তার কাছে নতুন নতুন জানার ও শেখার সুযোগ সৃষ্টি করে।

তুমি খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে

প্রথম প্রথম ত্যক্তবিরক্ত করতে থাকো খুব। কিন্তু হাঁটতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তার মনোভাবে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। নতুন এ সক্ষমতা অর্জন ও সেসবের প্রয়োগ নিয়ে মা-বাবা ও শিশুর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং তা শিশুকে সবসময় উত্তেজিত রাখে। যেরূপভাবে গ্রহগুলো অনুক্ষণ সূর্য প্রদক্ষিণ করে, তেমনিভাবে এ বয়সে শিশুর সমস্ত কর্মকাণ্ড পিতামাতাকে কেন্দ্র করে মূলতঃ আবর্তিত হয়। মা-বাবা থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে ফিরে তাকায়, আরও কিছু দূরে সরে যায় এবং নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফিরে এসে একবার তাদের স্পর্শ করে যায়। কেবল পরিচিত আবহাওয়ায় ও দুঃসাহসী শিশু এমনতরো কর্মচাঞ্চল্য প্রকাশ করে কখনো বা মা-বাবার আড়ালে অনেক দূর চলে যাওয়ার মতো সাহস প্রদর্শন করে। অন্যদিকে অপরিচিতজন ও পরিবেশে শিশু ভীতু হয়ে ওঠে এবং এসব করা হতে বিরত থাকে।

পিতামাতাকে নিরাপত্তার উৎস হিসাবে কিরূপ বিবেচনা করছে একজন শিশু, তা তার ও পিতামাতার মাঝে গড়ে ওঠা সম্পর্কের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে। অপরিচিত অবস্থায় কোনো খেলাঘরে শিশুকে একা ছেড়ে দিয়ে মা-বাবা ও শিশুর মধ্যে কিরূপ ঘনিষ্ঠতা আছে, তা কিছুটা আঁচ করা যায়। পিতামাতা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ শিশু খেলা বন্ধ  করে দেয়, কাঁদতে শুরু করে এবং মা-বাবার দিকে দ্রুত অনুসরণ করে। কিন্তু মা-বাবা ফিরে এলেই চমৎকার দৃশ্যটি দেখতে পাওয়া যায়। এ পর্যায়ে পিতামাতার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে যে শিশুটির, সে ফিরে পাওয়া পিতামাতাকে দ্রুত জড়িয়ে ধরবে, আদরে অভিষিক্ত হতে চাইবে, তারপর আপনমনে দেখতে শুরু করে। কিন্তু যে শিশুটির সঙ্গে পিতামাতার প্রগাঢ় সম্পর্কের সূচনা হয়নি, সে শিশুটি পিতামাতা ফিরে এলে রাগে-দুঃখে তাদের আঘাত করতে থাকে। অন্যদিকে যে শিশুর সঙ্গে তার বাবা-মার কোনো সম্পর্কই সৃষ্টি হয়নি, এক্ষেত্রে পিতামাতাকে ফিরে আসতে দেখে তার মনে বা আচরণে কোনো ভাবাবেগ দেখা যায় না। এরূপভাবে পিতামাতা চলে যাওয়ার সময়েও সে নির্লিপ্ত থাকে। প্রয়োজনীয় তথ্যটি এই, যে শিশুর সঙ্গে তার পিতামাতার সম্পর্কটি নিবিড়তা লাভ করেনি, এ বয়সের যে শিশু খুঁজে পায়নি কোনো নিরাপত্তা বোধ, ভবিষ্যতে সে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি ও আবেগ অনুভূতির স্বাভাবিক গঠনে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

কী কী কথাবার্তা বলতে পারে

এ বয়সের শিশু বলতে পারার তুলনায় বুঝতে পারে বেশি। যে বয়সে এসে শিশু, জীবনের প্রথম অর্থবোধক শব্দটি উচ্চারণ করে সাধারণতঃ তা শিশুর ১২ মাস বয়সের দিকে ঘটে। সেই বয়সে শিশু ‘না’, ‘বাই বাই’, ‘টা টা’ অথবা ‘আমাকে দাও’ এ ধরনের ছোটখাটো আদেশ-নির্দেশ যথাযথ পালন করতে পারে। ১৫ মাস বয়সের একজন শিশু শরীরের প্রধান অঙ্গগুলো দেখাতে এবং শুদ্ধ ও সাবলীলভাবে সঠিক বিশেষ্য পদ ব্যবহার করে ৪-৬-এর মতো শব্দ বলতে সক্ষম। সময়ে সময়ে অর্থহীন শব্দাংশ উচ্চারণ করে সে আনন্দ পায়। তবে এ বয়সে শিশুর বেশির ভাগ চাওয়া ও চিন্তাভাবনা শব্দবিহীন ভাষা বিনিময়ের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। যেন, অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি।

অভিভাবকের দায়িত্ব-কর্তব্য

শিশু বিকাশের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন ধাপ যেমন- মাকে চিনে হাসে, বসতে পারা, হামাগুড়ি দেওয়া ইত্যাদি কোন কোন বয়সে হয়েছে মনে রাখতে না পারলেও বেশিরভাগ মা-বাবা শিশু কখন থেকে হাঁটতে পারছে, তা মনে রাখেন। কেননা হাঁটতে পারাটি শিশু স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার প্রথম লক্ষণ হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে শিশু স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার এ সময় শারীরিক চোট লাগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অন্যদিকে শারীরিক ত্রুটি বা অক্ষমতার কারণে যেসব শিশু হাঁটতে পারে না, সেসব শিশুর পিতামাতা বা অভিভাবকের উচিত শিশুকে বিভিন্ন পরিবেশের সংস্পর্শে এনে সেসবে পরিচিত করে তোলা। শিশু ক্লিনিক বা চেম্বারে এসে একজন শিশু অপরিচিতি অবস্থায় পড়ে যেসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, সেরকম দেখাতে পারে। শিশুকে পরীক্ষা করে দেখার টেবিলে রাখা হলে অনেক টোডলার সেটি সহজে মেনে নেয়, তবে পরীক্ষা করার মুহূর্তে পিতামাতাকে সজোরে চেপে ধরতে পারে। এ অবস্থায় যেসব পিতামাতার সঙ্গে শিশুর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, সেসব শিশু পিতামাতার চেয়ে অন্য আগন্তুকের দিকে ব্যগ্রভাবে ঝুঁকে পড়ে। তখন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে এ ব্যাপারটি কখনো চিন্তার বিষয় হিসাবে খতিয়ে দেখতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *