মনোযোগ কোথায় গেল ?

ক্লাসে স্যার পড়াতে গিয়ে অনেক সময় এ কথা বলে থাকেন তোমার মনোযোগ কোথায় গেল? আসলেই, মনোযোগ কোথায় যায়? কেনই বা যায়? স্যারের লেকচার শুনতে শুনতে একজন হা হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে কিন্তু কিছুই শুনছে না। তার মনোযোগ অন্য কোথাও, সে সেই জগতের কল্পনায় বিভোর হয়ে আছে। বিষয়টা খুবই মজার। তোমরা অনেকেই এমন করো। তাকিয়ে থাকো, কিন্তু দেখো না। অথবা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখো ঠিকই কিন্তু শোনো না, কান তোমার অন্যদিকে। যেমন? কার্টুন দেখার সময় হয়ে গেছে তখন স্যার পড়াচ্ছেন। সেসময় কানটা আর স্যারের পড়াতে থাকে না। কান খাড়া হয়ে শুনতে থাকে পাশের রুমে টিভিটা কি চালু হয়েছে? কার্টুনটা কি শুরু হয়েছে? এমন হয় সবারই।

এই যে ‘কী দেখতে হবে’ অথবা ‘কী শুনতে হবে’ সেটা ঠিক করে দেয় মন। মন কানের বায়ুকে নির্দিষ্ট ঘটনার সাথে যুক্ত হবার জন্য মস্তিষ্ককে প্রোগ্রামিং দিয়ে দেয়। সে অনুযায়ী কান সেই ঘটনার আশেপাশের শব্দকে অস্পষ্ট করে দিয়ে নির্দিষ্ট ঘটনার শব্দগুলোকেই গ্রহণ করে। তাই সামনের ঘটনাই শোনা হয় না তোমার। সুতরাং মনোযোগ বাড়াতে হলে মনটাকেই আগে বাগে আনতে হবে। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সেটা খুব সহজ কাজ নয়।

মনকে বশে আনার মূলত ৪ টি পদ্ধতি আছে। যেমন ১. শান্তকরণ ২. নিয়মতান্ত্রিকতার শাসন ৩. পুরস্কৃত করা ৪. শাস্তি দেয়া। প্রমত শান্তকরণ। শান্তকরণ হলো মনকে স্থিরীকরণ। মনকে সকল প্রকার ব্যস্ততা থেকে কিছু সময়ের জন্য মুক্ত করে দেয়া। মনকে শান্তি দেয়া। মনকে বোঝানো যে এখন তুমি মুক্ত, কিছুক্ষণ বিশ্রাম করো। মন এই মুক্ত সময়টুকু পায় না। কাজ করতে করতে সে হাপিয়ে ওঠে। কিন্তু তারপরেও ছুটতে থাকে। তার কাজ যেন শেষ হয় না। তাই তাকে বিশ্রাম দিতে হবে। মনকে শান্ত করার পদ্ধতি হচ্ছে যোগ ব্যায়াম, রিলাক্সেশন, ধ্যান ইত্যাদি। মন শান্ত হলে সে শক্তি পায়। যেমন আমাদের দেহ ঘুমের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে, নিজেকে গুছিয়ে নেয়। ঠিক তেমনি জাগ্রত অবস্থায় মনকে কিছু সময়ের জন্য শান্ত হতে দিতে হয়। তারপর আবার মন পূর্ণ শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, মনকে নিয়মতান্ত্রিকতার শাসন করতে হবে। এর মানে হচ্ছে মনকে কাজের সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। মনকে জানিয়ে রাখতে হবে যেকোনো সময়ে তুমি কোন কাজ করো বা করবে। তাহলে দেখবে মন আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে আছে সে কাজের জন্য। তার পূর্ণ শক্তি সে নির্দিষ্ট কাজের পেছনে বিনিয়োগ করতে পারবে। নিয়মতান্ত্রিকতা মানে হলো কাজের রুটিন মেনে চলা। এর একটি বড় সুবিধা হলো মন যেমন খুশি তেমন কাজ করতে পারে না। তোমাদের বাসায় সবচেয়ে বেশি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে কে? দেখবে যাকে আমরা বেকার বলি, সেই মানুষটিই সবসময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। হয়তো তার কাজের একটি বড় অংশই কোনো রেজাল্ট আনে না। নির্দিষ্ট প্রকারের কাজ না থাকায় সে হাজারো অহেতুক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। যদি তোমার নির্দিষ্ট কাজ না থাকে তাহলে সে হাজারো কাজ বা চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। শুধু ছোটাছুটি করবে বানরের মত। চিড়িয়াখানায় যেমন দেখো বানর এক ডাল থেকে আরেক ডালে অথবা এক গ্রিল থেকে আরেক গ্রিলে লাফিয়ে বেড়ায়, মন-ও তেমনি। মন এখন একটি চিন্তা করে, মুহূর্তে আরেকটি চিন্তা শুরু করে দেয়। একটি কাজ শেষ না হতেই আরেকটির চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। তাই কোনোটিই ঠিকমতো করা হয় না। সেজন্যই মনকে রুটিন করে জানিয়ে দিতে হবে যেমন, শোনো- প্রতিদিন মাগরিব নামাজের পর থেকে এশার আগ পর্যন্ত আমি পড়বো। এটা যেন তোমার নোটে থাকে’। মন এ আদেশ অনুযায়ী তোমাকে পড়ার কাজে সাহায্য করবে। মনকে আদেশ দিলেই হবে না। নিজে বেশ কিছুদিন সে অনুযায়ী পড়তে বসতে হবে। তাহলে মন অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

তৃতীয়ত, মনকে পুরস্কৃত করতে হবে। শুনে হাসি পাচ্ছে? মনকে দেখা যায় না, ধরা যায় না তাকে আবার পুরস্কার দেবো কীভাবে? হ্যাঁ, এখানেই হচ্ছে মজা। নিজেকেই নিজে পুরস্কার দিতে হবে। যেমন মনকে আগে লোভ দেখালে যে, মন যদি এক সপ্তাহ টানা সন্ধ্যায় ঠিকমতো পড়তে বসো, তাহলে তোমাকে একটা ভালো চিপস/আইসক্রিম/চকোলেট খাওয়াবো। এক সপ্তাহ পরে নিজেই কিনে নিজেই খেলে। আর নিজেকে বোঝালে যে এটা তোমার কাজের পুরস্কার, তখন মন খুশি হয়ে যাবে। সে আরো উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে শুরু করবে। কথাগুলো শুনে উদ্ভট মনে হলেও বেশ কার্যকর। ট্রাই করে দেখো!

চর্তুত কাজ হলো, প্রয়োজনে মনকে শাস্তি দেয়া। এটি পুরস্কার দেয়ার মতোই নিজেকে নিজে শাস্তি দেয়া। এটা শারিরীক শাস্তিও হতে পারে, আবার বেশি কাজ চাপিয়ে দিয়েও হতে পারে। যেমন ধরো, এক সপ্তাহ পরেই তোমার পরীক্ষা। অথচ পড়তে বসতে ইচ্ছেই হচ্ছে না। শুধু খেলতে বা অন্য কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তখন নিজেই নিজের দু’গালে চড় মেরে দাও। তারপর নিজেকেই বোঝাও- শাস্তি পেয়েছো? এবার পড়তে বসো। অথবা ধরো, পরপর দুদিন ধরে কোনো এক ওয়াক্ত নামাজ মিস হয়ে যাচ্ছে। তখন অতিরিক্ত দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নাও। মনকে বোঝাও যে এটা তোমার জরিমানা। দেখবে মন তখন স্বাভাবিক নিয়ম মেনে চলতে চাইবে।

আসলে মন বড্ড বেয়ারা ধরনের। সে শুধুই ছুটতে চায়। মনকে শান্ত করে কাজ শুরু করতে পারলে সেই কাজে মনোযোগ আসে আর সফলতাও আসে। মনকে অস্থির রাখা এবং মনকে নির্দিষ্ট কাজ ভুলিয়ে দিয়ে অন্য অহেতুক, ফালতু কাজে লাগিয়ে দেয়া শয়তানের বড় একটি কাজ। শয়তান চায় যাতে করে মানুষ তার ভালো কাজটি না করুক অথবা সাফল্য না পাক। তাই তোমার যেকোনো ভালো কাজে শয়তান নানা প্রলোভন, নানা উদ্ভট চিন্তা নিয়ে হাজির হবেই। তাই ভালো কাজ শুরু করার আগে পবিত্র হয়ে শুরু করবে। যেমন তোমার পড়াশুনা শুরু করার আগে যদি অযু করে বসো, তাহলে দেখবে পড়তে মনোযোগ আসছে। আর একই সাথে শয়তান তাড়ানোর দোয়াটা পড়ে নেবে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাউত’নির রজিম’। যেকোনো ভালো কাজের আগে পড়তে হয় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। এতে করে কাজে বরকত আসে, আল্লাহর রহমত আসে।

মন একটি অসীম শক্তিশালী বিষয়। বিশালাকার দৈত্যের মন তোমাকে দিয়ে অনেক অচিন্তনীয় অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে তুলতে পারে। শুধু প্রয়োজন মনের শক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। তাই মনকে বশ করতে আজই লেগে পড়ো। মনোযোগ তৈরির যুদ্ধে সফল হলে তোমার লক্ষ্য অর্জন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

-শাকের জামিল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924