করোনাভাইরাসের এই সময়ে মেন্টাল হেলথ দিন যাপনের পরিকল্পনা

নতুন দেখা দেয়া করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ঘোষণার পর দেশে দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে এবং যত্ন নেওয়া হচ্ছে সোশালডিসটেন্সিং মেনে চলার ব্যাপারে। সব কাজকর্ম বন্ধ রেখে পরিবারগুলো নিজ ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে এবং বাইরের কারো সাথে মেলামেশা করবে না, কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করার উদ্দেশ্যে। প্রাথমিকভাবে কমপক্ষে ১৪ দিন এভাবে থাকার কথা; পরিবারের কারো শরীরে এই ভাইরাস ইতোমধ্যে সংক্রমিত হয়ে থাকলে তাও যেন প্রকাশ পেয়ে যায়। কিন্তু ঘরের সব সদস্য এইভাবে একত্রে সারাদিন কোন কাজকর্ম ছাড়া দিনের পর দিন থাকার সুযোগ আগে কখনো হয় নি। অফিস নেই, স্কুল-কলেজ নেই, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, বাজার ঘাট বন্ধ, খেলাধুলার জন্য বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না, পার্কে হাঁটার উপায় নেই!

সব মিলিয়ে এখন পরিবারের জগৎ রচনা করতে হচ্ছে শুধুমাত্র পরিবারের যেটুকু ঘর তার ভেতর এবং এই জগতের সদস্যরা হলেন ওই পরিবারের সদস্যরাই। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন রুচির এবং বিভিন্ন মেজাজের ছোট-বড় সদস্যরা সবাই মিলে দিনের পুরোটা সময় একসাথে যাপনের অভিজ্ঞতা অধিকাংশের জন্যই নতুন। তার উপর চারিদিকে মিডিয়া ও সোশ্যালমিডিয়ার নানা প্রকার খবর ও বিভিন্ন রিপোর্ট অযথা উত্তেজনা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করছে প্রায় প্রত্যেক সদস্যের ভিতরে!

কি হচ্ছে? কি হবে? ইত্যাদি নিয়ে টেনশন এবং মানসিক চাপ! কেউ হতাশ আর কেউ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিরাশায় নিমজ্জিত। করণায় মৃত্যুর ভয় তাড়িত করছে অনেককেই। কারো মেজাজ হয়ে যাচ্ছে রগচটা এবং কেউ বেপারোয়া ব্যবহার করছে মানসিক নানা মাত্রিক চাপের মধ্যে। এই ধরনের খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আগেই, পরিবারের মানসিকস্বাস্থ্য বা মেন্টালহেলথ সুরক্ষার জন্য পরিবারের প্রধানের এগিয়ে আসা উচিত এবং বাকি সদস্যদের আন্তরিক ভাবে সহযোগিতা করা উচিত।

মেন্টাল হেলথ কি? আমাদের আবেগ সম্বলিত মানসিক ও সামাজিক কল্যাণের সুরক্ষাই মেন্টাল হেলথ বা মানসিক স্বাস্থ্যের আওতার মধ্যে পড়ে। এটা প্রভাবিত করে আমাদের চিন্তা, অনুভূতি এবং কাজকে। কীভাবে আমরা মানসিক চাপের বিষয়টি সামাল দেবো, আর পারস্পরিক সম্পর্ক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কীভাবে এগোব সে ব্যাপারে মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের সাহায্য করে। যখন আমরা পুরো পরিবার নিয়ে একসাথে একই ঘরের মধ্যে দিনের পুরোটা সময় থাকছি তখন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে।

অনেকদিন পর কর্মহীন অফুরন্ত সময় পেয়ে যদি বড়রা অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমান, তারপর বাকি দিনটা টিভির সামনে বসে কাটিয়ে দেন, আর ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ রুমে অ্যান্ড্রয়েড ফোন বা কম্পিউটারে গেমস বা অন্য অশ্লীল কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং খাওয়া-দাওয়ার ঘুমের ও গোসলের যদি কোন শৃঙ্খলা না থাকে, তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো পরিবার হতাশাগ্রস্থ এক অবস্থার মধ্যে নিপতিত হবে। তাই, শুরু থেকেই শৃঙ্খলা মেনে চলার বিষয়টির দিকে মনোযোগ দেয়ার কথা বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন। হঠাৎ করে সকলেই একই ধরনের নিয়ম মেনে চলতে গেলে প্রত্যেকেরই কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং অভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে। অভ্যাসের পরিবর্তন খুব সহজ জিনিস নয়! তবু, প্রত্যেককে নমনীয় হয়ে সারাদিনের একটি সমন্বিত রুটিন তৈরি করতে হবে এ ব্যাপারে গৃহকর্তাকেই যত্নবান হতে হবে এবং ছোটদের সহ সকলের সাথে পরামর্শ করতে হবে।

এই রুটিন হবে শিক্ষা ও বিনোদনের এক গ্রহণযোগ্য মিশেল। এর মধ্যে কুরআন কেন্দ্রিক শিক্ষা, ইতিহাস, দর্শন এবং অন্য ভাষা শিক্ষার মতো সিরিয়াস বিষয় যেমন থাকবে তেমনি খেলাধুলা (যেমনঃ লুডু, কেরম, মনোপলি ইত্যাদি), গল্প (যেমনঃ দেশ-বিদেশের সেরা গল্প, ভুতের গল্প, শৈশব-স্মৃতির গল্প, বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্প), কৌতুক, আবৃত্তি, নাটিকা, সৃষ্টিশীল কাজ বা শখের (হবি)কাজ, ঘর সাজানোর কাজ, কাগজ দিয়ে নানা কিছু তৈরি করা, ইত্যাদির মত সকলের গ্রহণযোগ্য হালকা মেজাজের মনোরঞ্জনমূলক বিষয়গুলোও থাকবে। শারীরিক কসরত মূলক কাজ, বাগান বা ফুলের টবে কাজ করা এবং যোগ ব্যায়াম বা ইয়োগার মত বিষয়গুলোও থাকতে পারে। প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য সময় বেঁধে দিতে হবে এক থেকে দেড় ঘন্টার মতো।

দিনটা শুরু হবে ফজরের নামাজ দিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু মসজিদে গিয়ে জামাতেনামাজ পড়ার অবস্থা নেই তাই ঘরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে জামাতে নামাজ আদায় করার অভ্যাস করতে হবে। ফজরের নামাজের পর কিছুক্ষণ কোরআন তেলোয়াত ও কোরআন নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কুরআনের মজাদার গল্পগুলো এবং এর শিক্ষা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। গ্রামীণ জীবনে ছোটবেলায় কুরআন পড়তে গিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছিল বড়দের মুখে ছোটরা তা শুনতে পারে। এরপর সকালের নাস্তা। তারপর কোন বই নিয়ে আলোচনা অথবা সামষ্টিকভাবে একটি ইন্টারেস্টিং বই পাঠ করা এবং আলোচনা করা। এটা হতে পারে ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, দর্শন ইত্যাদি যে কোন ধরনের বই যা সকলের চোখের ঘুম ছুটিয়ে দেবে। এইভাবে একেকটি বিষয়কে সমন্বিত করে একেকটি পিরিয়ডের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রত্যেকটি কাজের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে হবে। কম বয়স্ক এবং ছোটদেরও প্রেজেন্টেশন থাকবে। জোহরের নামাজের পর দুপুরের খাবার ও বিশ্রাম হবে। বিকেল বেলা হালকা কিছু খেতে খেতে গল্প হতে পারে। তারপর বাগানের কাজ ও শারীরিক কসরত ইত্যাদি। সকালে শরীর চর্চার একটি ক্লাসে রাখা যায়, ছেলে মেয়ে সবার জন্য। এইভাবে সারাদিনের জন্য রুটিনটাকে সাজিয়ে নিতে হবে। অনেক সদস্যসহ বড় কোন যৌথ পরিবার হলে এধরনের অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রোগ্রাম করা যায়; যাতে প্রত্যেকটি দিন হয়ে যাবে আনন্দমুখর এবং প্রত্যেকেই মনে করবে যে তারা কিছু অর্জন করছে। ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য তা হয়ে যাবে মূল্যবান স্মৃতি। ইউওটিসি(UOTC), বিএনসিসি (BNCC), মুকুল ফৌজ, অথবা ফুলকুঁড়িরআসর-এর মতো সংগঠনগুলোর কয়েকদিনব্যাপী বার্ষিক ক্যাম্পে যোগ দেয়ার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাদের জন্য এই ধরনের একটি প্রোগ্রাম সাজিয়ে নেওয়া অত্যন্ত সহজ। আজকাল আমাদের যেমন তিন-চারজন বা কয়েকজনের মাত্র ক্ষুদ্র পরিবার তাতে খুব সহজেই দিনের কার্যক্রমকে সাজিয়ে নিয়ে কার্যকর করা সম্ভব।

এই ধরনের প্রোগ্রামে মানসিক স্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করার জন্য আরো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যেমনঃ সকলকে আত্মসমালোচনার সুযোগ দেয়া; কোন বিষয়গুলো আমাকে আজ উদ্বিগ্ন করলো এবং আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সেগুলোর তালিকা রচনা করা; আজকের কোন কোন কাজ বা ঘটনা আমার কাছে ভালো লেগেছে যার জন্য আমি আল্লাহর শুকর করতে চাই; আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি তা নিয়ে ছোট-বড় প্রত্যেকেই চিন্তাভাবনা করা এবং প্রত্যেককে কিছুক্ষণ কাগজ কলম নিয়ে লিখিতভাবে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া। যারা লিখতে চাইবে না তারা সবার সামনে মৌখিকভাবে তার মনের ভাব প্রকাশ করবে। এইভাবে আমরা মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা করতে পারি।

দিনের কোন একটা সময়ে, হতে পারে রাতের খাবারের পর, আমরা ভিডিওকলের মাধ্যমে বিদেশে অথবা দেশে দূরে অবস্থান করছে এমন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলতে পারি যা সবার মনকে ফুরফুরে করে দেবে।

এইভাবে সুশৃংখল ও আনন্দমুখর পরিবেশে বড়দের অভিজ্ঞতা এবং ছোটদের আবেগ ও স্বপ্নকে শেয়ার করে আমরা একটা পরিবেশ রচনা করতে পারি যেখানে প্রত্যেকেই উপকৃত হবে। এর ফল হবে এই যে, বর্তমানে আমরা যে বাধ্য হয়ে গৃহবন্দী অবস্থায় আছি সেটাও আমাদের কাছে খুব ভারী বলে মনে হবে না। তখন বরং বলবো যে আমরা একটা অসাধারণ সুযোগ পেয়েছি সবাই সম্মিলিত হয়ে সময়ের সদ্ব্যবহার করার।

বয়স্কদের বলব হঠাৎ সবাইকে হাতের কাছে পেয়ে শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষা এবং ইবাদতের কর্মকাণ্ড জোর করে চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, প্রত্যেকের মানস গঠন এবং গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে নেওয়ার ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি। তাই সবাইকে নিয়ে নমনীয় হয়ে আমাদেরকে চরিত্র গঠনের দিকে খেয়াল রেখে এই দিন যাপনের দিনপঞ্জী তৈরি করতে হবে। এরমধ্যে পঠন-পাঠন থাকবে, অভিজ্ঞতার শেয়ারিং থাকবে, জীবনের প্রস্তুতির বিষয়গুলো থাকবে, খোদাভীতি থাকবে, মৃত্যুর জন্য তৈরি হওয়ার মানসিকতা থাকবে, ভালো মানুষ হওয়ার ভালো কাজ করার এবং সুন্দর জীবনের আকাঙ্ক্ষা থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এর মধ্যে হাসি-আনন্দের অনেক বিষয় থাকবে।

আমাদেরকে অবশ্যই আশাবাদী হতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে দুর্যোগের ভেতর আশার হাতছানি সৃষ্টি করতে হবে। মানুষই পারে পিছলে পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে। মানসিক শক্তি দিয়ে দুঃসময়কে জয় করতে হবে। সুচিন্তা (পজিটিভ থিংকিং) দিয়ে হতাশাকে বিদায় করতে হবে। অলসতা ঝেড়ে ফেলতে হবে, কাজ করতে হবে শারীরিক ও মানসিকভাবে। চিন্তা ও মূল্যায়ন করতে হবে আমাদের কাজের এবং জীবনের।

মিরপুর, ঢাকা; ২/০৪/২০২০
আশরাফ আল দীন।।
শিক্ষাবিদ, কবি, গবেষক ও
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924