শিশুর আগ্রাসী আচরণে কি করবেন?

বিকেলে কলোনির মাঠে ফুটবল খেলছিল সমবয়সী শিশুরা। হঠাত্ এক বন্ধুর পায়ে লেগে আরেক বন্ধু চোট পায়। এ নিয়ে দুই পক্ষের তর্ক। শেষমেশ ঝগড়া গড়ায় মারামারিতে। পরে বেশি অভিযোগ আসে রাফসানের বিরুদ্ধে। সেই নাকি সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী আচরণ করেছে। রাফসানকে নিয়ে মা-বাবাকে প্রায়ই এ ধরনের অভিযোগের সম্মুখীন হতে হয়। অবস্থার উন্নতির জন্য এখন নিয়মিত রাফসানকে কাউন্সেলিং করাতে হচ্ছে।

ঝগড়া, মারপিট, কোনো কিছু ছিনিয়ে নেওয়া, নিজে যা চাই তাই করতে চাওয়ার প্রচণ্ড জেদ, রাগ, ক্ষোভ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনো কোনো শিশুর মধ্যে বেশি আগ্রাসী মনোভাব দেখা যায়। একই বিষয়ে অন্য বন্ধুরা ভূমিকা নিলেও একজনকে দেখা যায় বেশি রেষারেষিতে জড়াতে। ফলে তার নামেই বেশি অভিযোগ আসে মা-বাবার কাছে। মা-বাবাও অভিযোগ পেয়ে একহাত দেখে নেন সন্তানকে। ভাবেন এতে সন্তান শোধরাবে। কিন্তু ফল হয় উল্টো।

শিশুর মধ্যকার আগ্রাসী আচরণ ওদের মানসিক ও আচরণগত বিকাশেরই একটি সাধারণ অংশ বলে মনে করেন মানসিক বিশেষজ্ঞরা। তিন-চার বছর বয়স থেকেই শিশুদের মধ্যে এই ধরনের আচরণ দেখা যায়। শিশু যাতে আগ্রাসী মনোভাবের না হয়, তার জন্য দরকার আলাদা যত্ন। এ ধরনের শিশুকে সময় নিয়ে বোঝাতে হয়। দীর্ঘ কাউন্সেলিংয়ে আগ্রাসী শিশুরা ধীরে ধীরে নিজেদের ভুল বুঝতে শেখে এবং একসময় নিজ থেকেই সংশোধন হয়।

শিশুকে বুঝিয়ে বলুন

শিশুরা রাগের অনুভূতি ও আগ্রাসী আচরণের পার্থক্য বুঝতে পারে না। এ জন্য শিশুকে অনুভূতি প্রকাশ করা শেখানো প্রয়োজন। শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করুন। ওদের সঙ্গে খোলামনে কথা বলুন, যাতে শিশু তার রাগ, হতাশা ও ব্যর্থতার কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারে। শিশুকে বোঝান রাগ হওয়া স্বাভাবিক। তাই বলে রাগের বশবর্তী হয়ে কাউকে কখনোই আঘাত করা যাবে না। রেগে গেলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।

পারিবারিক আচরণে সংযত হোন

নির্দিষ্ট কিছু পারিবারিক আচরণ জন্মের আগে থেকে শুরু করে শৈশব পেরোনোর আগ পর্যন্ত শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে। এ জন্য শিশুর সামনে আচরণে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া খুব জরুরি। অনেক পরিবারে বিভিন্ন কারণে সাংসারিক অশান্তি দেখা দেয়। মা-বাবা শিশুদের সামনেই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেন। এগুলো শিশুমনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরিবারে অশান্তি বা আগ্রাসী কিছু দেখলে তাদের মধ্যেও অনেক সময় আগ্রাসী মনোভাব জন্ম নিতে পারে।

রাগ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিন

শিশুর মধ্যে আগ্রাসী আচরণের কারণ হচ্ছে তারা রাগ বা জেদ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে একই ঘটনায় অন্যরা প্রতিক্রিয়া না দেখালেও সে মারপিট বা রেষারেষি করে ফেলে। এ জন্য ছোট থেকেই শিশুকে রাগ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিন। ওকে বোঝান, রেগে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া। রাগের ফল ভালো হয় না। বেশি রাগের ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে এ বিষয়ে ধারণা দিন। কাউকে আঘাত করলে সে ব্যথা পায়; এতে মানুষ তাকে ভালো নয়, বরং খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করে। এসব বিষয়ে শিশুকে গল্পচ্ছলে বুঝিয়ে বলুন।

কথার মাধ্যমে অনুভূতি বোঝাতে বলুন

অনেক শিশু শপিংয়ে গিয়ে কিছু পছন্দ হলে সেটা না নিয়ে আসতে চায় না। কিংবা দলগত খেলনা একাই দখল করে বসে থাকে। ওর কাছ থেকে কেড়ে নিলে আবেগতাড়িত হয়ে লাথি মারা, চিত্কার করা, আঘাত করার মতো আগ্রাসী আচরণ শুরু করে। এর কারণ বড়দের মতো করে তারা ভাষার মাধ্যমে নিজের চাওয়াটা ভালোভাবে বোঝাতে পারে না। ওদের উদ্বেগ ও হতাশা মোকাবেলা করতে অসুবিধা হয়। ফলে আগ্রাসী আচরণ করে। এ জন্য দরকার সঠিক সহবত শিক্ষা। সেটা ছোট থেকেই শিশুকে শিখিয়ে দিন।

আগ্রাসী আচরণের প্রতিক্রিয়া দেখান

শিশু যখনই আগ্রাসী আচরণ বা মনোভাব ব্যক্ত করবে, তখনই এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখান। চেষ্টা করুন সব সময় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানোর। শিশুর আগ্রাসী আচরণের সময় মন খারাপ থাকলে বকবেন বা শাসন করবেন আর মন ভালো থাকলে হেসে উড়িয়ে দেবেন—এমনটা করা যাবে না। শিশুর আগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে সব সময় একই প্রতিক্রিয়া দেখালে একসময় নিজ থেকেই শিশু এই মনোভাব পরিহার করতে শুরু করবে।

শিশুকে পুরস্কৃত করুন

শিশুকে আগ্রাসী আচরণের ভালো-মন্দ শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি এগুলো মেনে চলার জন্য প্রতিযোগিতা করতে বলুন। ৭ দিন, ১০ দিন, ১৫ দিন এভাবে ব্যাপ্তি নির্ধারণ করে দিন। এই সময়ে আগ্রাসী আচরণ না করলে এবং বুঝিয়ে দেওয়া বিষয়গুলো মেনে চললে তার পছন্দের কোনো জিনিস উপহার দিন। অথবা বাইরে খেতে বা ঘুরতে নিয়ে যান। এভাবে খুব দ্রুত শিশুরা নিজেদের আগ্রাসী মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে।

বাইরের জগতের সঙ্গে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দিন

কম্পিউটার, মোবাইল, গেমস, ঘরকুনো স্বভাব থেকে শিশুকে বেরিয়ে আসতে উত্সাহ দিন। একাকিত্বের ফলে শিশুদের মধ্যে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলা, খেলাধুলার আনন্দসহ নানা বিষয় অজানা থেকে যায়। এ জন্য শিশুকে ভালো বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে বলুন। সবচেয়ে ভালো হয় শিশুকে বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এতে শিশু বাইরের জগতের আনন্দ সম্পর্কে জানতে পারবে। আগ্রাসী আচরণ থেকে আপনা-আপনি সরে আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *