শিশুর অ্যাজমার মারাত্মক লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়

অ্যাজমা বা হাঁপানি হলো শ্বাসকষ্টজনিত একটি ব্যাধি। যা শিশুদের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। আবহাওয়ার পরিবর্তন কিংবা শীত পড়তেই শিশুর হাঁপানির সমস্যা বেড়ে যায়। সাধারণত অ্যালার্জির সমস্যার কারণে অ্যাজমা দেখা যায়। এ সময় শিশুদের বাড়তি যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।

রোগজীবাণুর সংক্রমণে শ্বাসনালীর ভেতরের স্তরে প্রদাহ হওয়ায় ফুলে ওঠে। ফলে শ্বাসনালীর চারপাশের মাংসপেশি সংকুচিত হয় ও বাতাস চলার পথ সরু হয়ে যায়। উত্তেজক পদাথের্র প্রভাবে শ্বাসনালীর গ্রন্থি থেকে প্রচুর মিউকাসজাতীয় আঁঠালো কফ নিঃসৃত হয়ে শ্বাসনালীতে জমা হয়। যা বাতাস চলাচলের পথ আটকে দেয়।

নবজাতকদের ক্ষেত্রে শ্বাসনালীটি তুলনামূলক বড় বাচ্চাদের তুলনায় ছোট ও সরু হয়। আর ছোট শ্বাসনালীগুলো ভাইরাল বা ছত্রাক সংক্রমণ ও শ্লেষ্মা দ্বারা সহজেই অবরুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়।

অ্যাজমা কেন হয়?

এমনকি আবহাওয়ার পরিবর্তন, ঠান্ডা লাগা, বিশেষ কিছু খাদ্য, কিছু ওষুধ, শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত কোনো রাসায়নিক পদার্থ, শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম প্রভৃতি। দূষিত বাতাস গ্রহণের জন্য শিশুদের মধ্যে হাঁপানির প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

শিশুর অ্যাজমার লক্ষণ

সাধারণত অ্যাজমায় আক্রান্ত শিশুর বুকে অস্বস্তি হয়। ফলে দম বন্ধভাব হয়। শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট অনুভব করে শিশু। বুকের ভেতর শো শো শব্দ হয়। সঙ্গে ঘন ঘন শুষ্ক কাশি হাঁপানির অন্যতম লক্ষণ। এ ছাড়াও গলার নিচের অংশ ও দুই পাঁজরের নিচে ও মধ্যবর্তী অংশ শ্বাস নেওয়ার সময় ভেতরে ঢুকে যায়।

চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে পারে না শিশু। এসব উপসর্গ সাধারণত রাতের বেলায় বেড়ে যায়। মা-বাবারা প্রায়শই চিন্তিত হয়ে ওঠেন, তবে শিশু যে অ্যাজমায় ভুগছে তা টের পান না। শিশুদের অ্যাজমার লক্ষণের মধ্যে অন্যতম হলো দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া।

৩ মাসের শিশুর সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাসের ধরন হলো প্রতি মিনিটে ৩০-৬০ বার। এই শ্বাস-প্রশ্বাসের ধরন আবার তিন মাস থেকে পরিবর্তিত হয় ও প্রতি মিনিটে হয়ে দাঁড়ায় ২০-৪০ বার। তবে অ্যাজমা আক্রান্ত শিশুর মধ্যে শ্বাস নেওয়ার পরিমাণ ৫০ শতাংশের মতো বাড়তে দেখা যায়। তাদের বুক শক্ত হয়ে থাকে।

অ্যাজমায় আক্রান্ত শিশুর খেতে সমস্যা হয়। তারা ক্লান্ত ও অলস থাকে সব সময়। এমন শিশুরা খুবই আস্তে কান্না করে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকায় শিশুর ঠোঁট ও নখের আস্তরণ নীলচে অথবা বিবর্ণ দেখা যায়।

উন্নত বিশ্বের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় শতকরা ১০-২০ ভাগ স্কুলবয়সী শিশুদের হাঁপানি রোগ আছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬০ লাখ শিশু (শিশুদের ৭.৪%) হাঁপানি রোগে ভুগছে। শিশুদের হাঁপানিকে সাধারণত ঠান্ডা, সর্দি-কাশি, ব্রংকাইটিস ও ব্রংকিওলাইটিস, হাঁপি-টানের দোষ, নিউমোনিয়া ইত্যাদি বলে অবজ্ঞা করা হয়। অনেকেই ধারণা করেন বড় হলে রোগটি সেরে যাবে।

পরিবারে কারও অ্যাজমা থাকলে শিশুরও হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়াও শিশু যদি ধূলিকণা, পরাগরেণু, উদ্ভিদ তন্তু, ছত্রাক ও ছত্রাকের বীজের প্রতি অ্যালার্জিপ্রবণ হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রেও শিশুর অ্যাজমা হতে পারে।

আবার শিশু একজিমায় আক্রান্ত হলে তার অ্যাজমা হওয়ারও সম্ভাবনা ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। একজিমা ও অ্যাজমার মধ্যস্থ পারস্পরিক সম্পর্ক বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। উভয় ব্যাধিই একই ধরনের মিউট্যান্ট জিনের কারণে হয়। শিশুর যদি অ্যালার্জি প্রবণতা থাকে, সেক্ষেত্রে তার মধ্যে ইওসিনোফিলের (এক ধরণের শ্বেত রক্তকণিকা) সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে।

শিশুর অ্যাজমার চিকিৎসা ও ওষুধ

শিশুর রক্ত ও লালাতে ৪ শতাংশেরও বেশি ইওসিনোফিল থাকলে সে হাঁপানি বা অ্যাজমায় আক্রান্ত হতে পারে। শিশু অ্যাজমায় আক্রান্ত বলে মনে হলে কী কী পরীক্ষা করা হয়?

>> মিউকাস বা শ্লেষ্মা জমে আছে কি না সেজন্য বুকের এক্স-রে করা হয়।

>> শিশুর রক্ত পরীক্ষা করানো হতে পারে তার ইওসিনোফিলের সংখ্যা নিরীক্ষণ করা হয়।

>> উপশমকারী ওষুধ প্রয়োগের আগে ও পরে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করলেই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।

>> পাঁচ বছর বয়সের অধিক বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে পিক-ফ্লো মিটার ব্যবহার করা যায়। এর সঙ্গে পরিবারের অ্যালার্জি, একজিমা বা হাঁপানির ইতিহাস থাকলে রোগ নির্ণয় আরও সহজ হয়।

অ্যাজমার ওষুধ সাধারণত ৩ ধরনের হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণের ওষুধ- এই ওষুধগুলো শিশুদের সমস্যার তীব্রতার উপর নির্ভর করে। এটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করতে হতে পারে।

দ্রুত স্বস্তিদায়ক ওষুধ- শ্বাসকষ্ট, সোঁ সোঁ শব্দে নিঃশ্বাস পড়া ও বুকের মাংসপেুশি শক্ত হয়ে ওঠার সমস্যায় এই ওষুধগুলো দ্রুত স্বস্তি দেয়।

অ্যালার্জিজনিত হাঁপানির ওষুধগুলো দ্রুত স্বস্তি প্রদানকারী ও দীর্ঘমেয়াদী হাঁপানির ওষুধের সঙ্গে একত্রে কাজ করে।

অ্যাজমার প্রতিরোধ ব্যবস্থা

>> সিগারেটের ধোঁয়া, যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ইত্যাদি থেকে শিশুকে দূরে রাখুন।

>> শিশুর ঘর পরিষ্কার ও ধুলামুক্ত রাখুন।

>> সপ্তাহে অন্তত একবার বিছানার চাদর, বালিশের কভার ও অন্যান্য জিনিস ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিন।

>> শিশুকে নরম পশমি জাতীয় খেলনা দেবেন না।

>> বাসায় বাইরে গেলে ধুলাবালি থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করুন।

>> শিশুর ঠান্ডায় অ্যালার্জি থাকলে এয়ার কন্ডিশন থেকে দূরে রাখুন।

>> বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখুন।

>> ধৌতকরণযোগ্য খেলনাগুলো শিশুকে দিন। সপ্তাহে অন্তত একদিন সেগুলোকে ধুয়ে দিন।

>> পোষ্য প্রাণী থেকে শিশুকে দূরে রাখুন।

>> প্রয়োজনে এয়ার পিউরিফায়ার ও হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন।

>> অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে এ ধরনের খাবারগুলো এড়িয়ে চলুন।

শিশুকে কখন হাসপাতালে নিতে হবে সেটা অবশ্যই পিতামাতাকে বুঝতে হবে। যেমন-

>> বিশ্রামরত অবস্থায় শ্বাসকষ্ট হলে।
>> নেবুলাইজার ব্যবহার করার পরও শ্বাসকষ্ট না কমলে।
>> শ্বাসকষ্টের কারণে খেতে না পারলে কিংবা বমি হলে।
>> শ্বাসকষ্টের সময় কথা বলতে না পারলে কিংবা বাক্য সম্পন্ন করতে না পারলে।

সঠিক চিকিৎসা ও যথাযথ যত্ন নিলে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ হবে। তবেই শিশুর মধ্যে এই দীর্ঘমেয়াদী ব্যাধিটির মোকাবিলা করা সহজ হবে। এর সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে।

লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল; প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *