নারী ও শিশু-কিশোরদের সাইবার বুলিং বা অপরাধ দমনে চাই বিশেষ সতর্কতা

সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের যাবতীয় একাকিত্বের এক নিজস্ব সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মানুষের জীবনঘটিত প্রতিটি কাজেই প্রভাব ফেলছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ প্রভৃতির মাধ্যমে সাইবার অপরাধীদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন অনেকেই। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাইবার বুলিং, নারী ও শিশুরা এর প্রধান শিকার। বিশ্বের ১৬০টি দেশের সাইবার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল উন্নয়ন পরিস্থিতি বিবেচনায় তৈরি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ ধাপে উন্নীত হয়েছে। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৬৫তম। এটি বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা বিধানের সক্ষমতারই প্রতিফলন।

শিশু কিশোর-কিশোরী ও নারীরাও প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে কারও ব্যক্তিগত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন বা অন্যায় কোনো কিছুতে প্রলুব্ধ করাই হলো সাইবার বুলিং। কিশোর-কিশোরীরাই প্রথম দিকে এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছিল। এখন মধ্যবয়সীরাও এ ফাঁদে পা দিচ্ছেন। সম্প্রতি সাইবার বুলিংকে এখন বিশ্বের বড় সমস্যা বলছেন আন্তর্জাতিক শিশু পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশের নড়াইল জেলার সাদাত রহমান। ‘সাইবার বুলিং’ থেকে শিশুদের রক্ষায় কাজ করে ‘আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার’ পান নড়াইলের এই কিশোর। পুরস্কার গ্রহণের পর সাদাত বলেন, ‘সাইবার বুলিং কেবল বাংলাদেশ নয়; এটি এখন ইন্টারন্যাশনালি অনেক বড় সমস্যা। সাইবার বুলিং নিয়ে সারাবিশ্ব এখন উদ্বিগ্ন। এ সমস্যা সমাধানে সারাবিশ্বকে আজ এগিয়ে আসতে হবে।’

স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা এখন অনলাইনে বেশি সময় ব্যয় করছে। এতে করে অনলাইনে শিকার হওয়ায় ঝুঁকি বেড়েছে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ইউরোপল। তারা জানিয়েছেন, শিশু নিপীড়কদের সক্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে। বাসায় শিশুরা একা একা ইন্টারনেট ঘাটছে বলে তাদের প্রতি অভিভাবকদের নজরও থাকছে কম। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের ফুসলানো নিপীড়কদের জন্য বেশ সহজ। শিশুরা যাতে উদ্বিগ্ন না থাকে সে বিষয়ে অভিভাবকদের লক্ষ রাখতে হবে। নিয়মিত তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। জানতে হবে অনলাইনে তারা সারাদিন কী করেছে।

বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার। দেশের শতকরা ৪৯ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী এবং ৭৩ শতাংশ নারীরাও সাইবার বুলিংয়ের নিয়মিত শিকার। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন চতুর্থাশ নারীই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। তবে এ বিষয়টি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। মাত্র ২৬ শতাংশ অনলাইনে নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ করে অভিযোগ দায়ের করেন। যদি বিষয়টি পারিবারিক গণ্ডির বাইরে চলে যায় তবে আইনের আশ্রয় নিতেই হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশি ঝামেল এড়িয়ে চললেই বরং বিপদ। আর তা ভিকটিমকে বিপথেই পরিচালিত করবে। কিছু ধাপ অনুসরণ করলে এই কঠিন কাজই খুব সহজে হয়ে যায়। এর মধ্যে প্রথম কাজ হচ্ছে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা। তবে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা না নিয়ে একা একা থানায় যাওয়াটাও বোকামি। সঙ্গে রাখতে হবে হয়রানির প্রমান ও স্ক্রিন শর্ট কিংবা মেসেজ।

স্মার্টফোন, কম্পিউটারে খারাপ তথ্য, নোংরাÑঅশ্লীল মেসেজ, ই-মেইল, অডিও ক্লিপ, ভিডিও পাঠিয়ে শিশুদের উত্ত্যক্ত করা হয়। সে সঙ্গে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি বিকৃত করে ছেড়ে দেয়া প্রভৃতি উপায়ে শিশু-কিশোরদের সাইবার বুলিংয়ের মাধ্যমে তাদের মনো-সামাজিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে। সাইবার বুলিংয়ে চুপ থাকার নীতিই বড় ক্ষতির অন্যতম কারণ। পরিবারের কথা ভেবে কিংবা সম্মান হারানোর ভয়ে অনেকেই সব চুপচাপ সয়ে যান কিংবা চেপে যান। অপরাধীরা এর ফলে আরও বেশি সুযোগ নেয়। তারা আর্থিক সুবিধা আদায় করতে করতে এক সময় ভিকটিমকে যৌন নির্যাতনের ফাঁদেও ফেলে।

মা-বাবা যদি সহজেই সন্তানের বন্ধু হতে পারে তাহলে এ সংকট নস্যি। সাইবার বুলিং কী, ভার্চুয়াল জগতের পরিচিতরা কেন অনিরাপদ এবং একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য কেন সবার সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না এগুলো সন্তানদের বুঝিয়ে বলতে হবে। ভার্চুয়াল জগতে সন্তান কোন মাঠে খেলছে সেদিকে নজর দিতে হবে তারই সঙ্গী হয়ে। এ জন্য গণসচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, সাইবার অপরাধ-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনে হওয়া ৭ হাজার মামলার বেশিরভাগেরই ভুক্তভোগী নারী। এ ছাড়া অনলাইন ব্যবহারকারী ১০০ জন নারীর মধ্যে ৭৩ জনই সাইবার বুলিংয়ের মাধ্যমে হয়রানি শিকার হন। সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের অন্তত ৫টি ইউনিট থাকলেও পুরুষ সদস্য দিয়ে পরিচালিত হওয়ায় সেগুলোয় যান না নারীরা। এ বাস্তবতায় শুধু নারী পুলিশ সদস্যদের পরিচালনায় ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামে নতুন ইউনিট গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। সাইবার-সংক্রান্ত জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ‘সাইবার লাইফ’ অনুষ্ঠান সম্প্রচার হচ্ছে। জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে সাইবার সচেতনতা মাস পালিত হয়েছে গত মাসে।

দেশে ২০০৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ আইন তৈরি হয় এবং পরে এ আইন সংশোধন করা হয়। এ আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছে করে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা বা অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে বা যার মাধ্যমে মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলা ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়া হয়, তাহলে তার এই কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

সাইবার বুলিং কিংবা সাইবার নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়টিও বর্তমানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিশুদের, বিশেষত মেয়েশিশু, কিশোরীদের ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে। সম্ভাব্য সব ধরনের সাইবার বুলিং সম্পর্কে পরিচিত করতে হবে। সেইসঙ্গে এগুলোর ক্ষতিকর ফলাফলও দেখিয়ে দিতে হবে। পরিবারের অভিভাবক ও বড়দের খেয়াল রাখতে হবে ছোটরা স্মার্টফোনে বা কম্পিউটারে কী দেখছে, কী করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ সম্পর্কে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়মিতভাবে পরিচালনা করতে পারে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে যে অ্যাকাউন্ট থেকে খারাপ প্রস্তাব বা কুমন্তব্য আসে তা ব্লক করে দিতে হবে। সামাজিক মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতিতে ঘটে থাকলে সেসব মাধ্যমে রিপোর্ট করে দিলেও কাজ হয়। তাছাড়া ফোন ও অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে হবে। সন্তানদের সতর্ক করতে হবে যেন কোনোভাবেই এসব পাসওয়ার্ড  কোনো বন্ধুর সঙ্গেও শেয়ার না করে। হয়রানির শিকার যে কেউ এখন ৯৯৯ অথবা পুলিশের ফেসবুক পেজে নক করলেও সহায়তা পাবেন। এছাড়া মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হটলাইন ১০৯২১ নম্বরে গোপনীয়তা রক্ষা করে এ ধরনের সমস্যার সমাধান করা হয়। সরাসরি বিটিআরসি’র ফোনে ও ই-মেইলেও অভিযোগ করা যায়। এ ছাড়া অভিযোগ করা যায় পুনবৎযবষঢ়Ñফসঢ়.মড়া.নফ, সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে ০১৭৬৫৬৯১৮২২ এবং ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন সিসিটিসি। তাছাড়া হেল্পলাইন হ্যালো সিটি অ্যাপসের মাধ্যমেও অভিযোগ করা যাবে।

সাইবার বুলিং বা অন্যান্য আচরণগত সমস্যা শিশু-কিশোরদের মধ্যে যেন গড়ে উঠতে না পারে, সে জন্য কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন প্রতিদিন পরিবারের সবাই একসঙ্গে কমবেশি সময় কাটানো। অনেক সময় মা-বাবা দুজনেই চাকরি করে; সন্তানদের স্কুল-পড়াশোনা প্রভৃতি ব্যস্ততার মাঝেও একসঙ্গে খেতে বসা, কিছু সময় গল্প করা বা অন্যভাবে সময় বের করে নিতে হবে তাদের কথা শুনতে হবে। এতে শিশু-কিশোরদের গতিবিধি বুঝা যাবে। ফাঁকে ফাঁকে তাদের ভালো-মন্দের পার্থক্য  শেখাতে হবে। ছোটবেলা থেকেই বুলিংয়ের কোনো ঘটনা ঘটলে তা নিজের মধ্যে চেপে না রেখে মা-বাবা বা স্কুলশিক্ষকদের জানানোর শিক্ষা দিতে হবে। গাইড করতে হবে, সর্বোপরি নিঃশর্ত ও অকৃত্রিম ভালোবাসা দিতে হবে তাদের। সারাদিনের কাজের জন্য প্রশংসা করতে হবে। খেলাধুলা, ব্যায়াম ও অন্যান্য সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে।

সাইবার বুলিং একটি জঘন্য আচরণগত ব্যাধি। একে সমাজ থেকে নির্মূল করা জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন সবার আন্তরিক উদ্যোগ। শিশু-কিশোরদের বিকাশকালে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সবাইকে দায়িত্ব হতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং প্রতিরোধে সরকারিভাবে নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত। শিশুদের সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজে সম্পৃক্ত রাখতে হবে যেন তারা বিপথগামী না হয়। সেইসঙ্গে সাইবার বুলিং প্রতিরোধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে কঠোর বিধান রাখা এবং এর বাস্তবায়ন করা জরুরি। আরও জরুরি ছেলেমেয়েদের সাইবার জগৎ এবং এর যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করা।

পিআইডি নিবন্ধন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924