শিশুর অধিকার আদায় করতে সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতাও জরুরি

শিশুরা দেশের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ, কেন না তাদের হাত ধরেই আসবে সমষ্টিগত উন্নয়ন। শিশুর উন্নয়ন ও শিশু সুরক্ষায় সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও উদ্যোগের পরও শিশুর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। শিশুর পরিপূর্ণ সুরক্ষায় শুধু আইন পর্যাপ্ত নয়, আইন বাস্তবায়নে প্রয়োজন সচেতন জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে থাকে। এ বছর ৩রা অক্টোবর সোমবার সারা দেশে পালিত হয়েছে বিশ্ব শিশু দিবস। একইসঙ্গে শিশুর অধিকার, সুরক্ষা এবং শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সকলকে অধিকতর উদ্যোগী ও সচেতন করার লক্ষ্যে ৪ থেকে ১১ই অক্টোবর পর্যন্ত পালন করা হচ্ছে শিশু অধিকার সপ্তাহ। বিশ্ব শিশু দিবস ২০২২ এর প্রতিপাদ্য ‘গড়বে শিশু সোনার দেশ, ছড়িয়ে দিয়ে আলোর রেশ’ আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা. এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন… স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে এসে সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র অনেকটাই আশাব্যঞ্জক। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে অনেকাংশে সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশ আজ নানাভাবে সুপরিচিত।

অনেক ক্ষেত্রে দেশের আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন সত্ত্বেও শিশুদের জন্য ইতিবাচক সম্ভাবনার কোনো জায়গা কি তৈরি করা গেছে? সার্বিকভাবে কেমন আছে দেশের শিশুরা? একটি তথ্য বলছে, গত ২ বছর  করোনার করালগ্রাসে অনেক শিশুই অবেলায় তাদের শিক্ষা জীবনের ইতি টেনেছে! ইউনিসেফ ও ইউনেসকোর তথ্য মতে, পুরো দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শিক্ষা জীবন অনেকটাই ঝুঁকির মুখে। স্কুলের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই।

এরইমধ্যে মা-বাবার প্রাত্যহিক কাজের সহযোগী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। অনেকেই নতুন করে উপার্জনকারী ‘শ্রমিক’ হিসেবে যুক্ত হয়েছে। গৃহকর্মে, ইটখোলায়, কলকারখানায়, হোটেলে, রিকশা-ভ্যানচালক, এমনকি মাদক-জুয়ার আসরেও তারা শ্রম বিক্রি করছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায় ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের। এই বয়সীদের মধ্যে অনেকেই সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। অথচ আইনের এই বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করে অনিয়মতান্ত্রিক শিশুশ্রম ব্যবহৃত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। শিশুদের দিয়ে করানো হচ্ছে ভারী কাজ, যা শিশু সুরক্ষা তথা শিশু অধিকারের পরিপন্থি।

বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা শিশুশ্রম রোধে নানা কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেও শিশুশ্রম কমছে না। শিশুশ্রম বন্ধের লড়াইয়ে আমরা যেন হারতে বসেছি। করোনার ভয়াল থাবার পরপরই অনিয়ন্ত্রিত বাজারমূল্য আমাদের অনেক পেছনে ঠেলে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৭ লাখ শিশুশ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে ১৯ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যা তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার জন্য ক্ষতিকারক।
শৈশবে যার হাতে থাকার কথা ছিল বই আর পেন্সিল, যাদের হাত ধরে এ দেশ নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার কথা, তারাই আজ জীবনের প্রয়োজনে অভাবগ্রস্ত সংসারের সংগ্রামী সৈনিক সেজেছে। পরিবারের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে নামমাত্র পারিশ্রমিকে অনেকেই তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে। শুধু বয়সে কম অথবা শিশু হওয়ার জন্যই তাদের শ্রমের মূল্য খুবই কম ধরা হয়।
পৃথিবীজুড়েই শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক কর্মসূচি গৃহীত হলেও শিশু নির্যাতন তথা শিশু অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি থেমে নেই।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিশু অধিকার সনদে মূলনীতি হিসেবে ১. বৈষম্যহীনতা, ২. শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা, ৩. শিশুর অধিকার সমুন্নত রাখতে অভিভাবকদের দায়িত্ব এবং ৪. ‘শিশুদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন’-এর কথা উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশে এর যথাযথ প্রয়োগ নেই বললেই চলে। মজার ব্যাপার হলো, একই ছাদের নিচে বাড়িওয়ালার শিশুসন্তানরা যখন ঘুমকাতুরে হয়ে সকাল ১০টায় বিছানা ছেড়ে ওঠে, একই বয়সী শিশু গৃহকর্মীকে সেখানে কাকভোরে উঠে রুটিনমাফিক ভারী কাজে মনোনিবেশ করতে হয়! নিয়মিত কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হলেও কোনো দিন কোনো বাড়তি প্রশংসা জোটে না। আবার কোনো ত্রুটি ঘটে গেলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয় তাদের। শিশু অধিকার সনদ কাদের জন্য?

শিশুশ্রম কেবল একটি শিশু বা তার পরিবারকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে না, বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলে তার সব সম্ভাবনা। নিষ্পাপ শিশুর শৈশবকে যারা গলা টিপে হত্যা করে বা যারা প্ররোচিত হতেও বাধ্য করে, তারা আসলে কেমন মানুষ! মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হলো প্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা। কিন্তু অনুকূল পরিবেশের অভাবে অন্য আরেকটি মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ অন্ন জোগাড় করতে শৈশবেই তাকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। কাজ ভারী হলেও পারিশ্রমিক দেয়া হয় কম।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৮.৭-এ বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে নেয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড পরিস্থিতি, সঠিক কর্মসংস্থানের অভাব ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাংলাদেশে নতুন করে দরিদ্রের হার বাড়ছে। বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যাও।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রম নিয়োগ সম্পর্কে যে মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে মূলত ৪টি মাত্রার কথা বলে হয়েছে: সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, যৌথ দর-কষাকষির অধিকার, শিশুশ্রমিকের অনস্তিত্ব ও বৈষম্যহীন নিয়োগব্যবস্থা। এগুলো নিশ্চয়ই সব দেশে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এর প্রয়োগ কৌশল নিয়ে। আর অনেকেই শিশুর উন্নয়নে অনেক কাজ করে গবেষণা করে। বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। শিশুশ্রম বন্ধ হয় না।
শিশুশ্রম ও শিশু অধিকারের বিষয়টি আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। বাস্তবতা হলো, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে শিশুশ্রম কমবে না; শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অনেক বড় ভূমিকা নিতে হবে। সুন্দর আগামীর জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতাও জরুরি। আর শিশুরাই তো জাতির ভবিষ্যৎ। তারাই আগামী দিনে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেবে। জ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে তুলবে সকলের জন্য কল্যাণকর নতুন বিশ্ব। বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোররা বিশেষ করে যারা শহরাঞ্চলে থাকে, তারা মাঠে বা বাইরের খেলাধুলার চাইতে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটে সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। বিশেষজ্ঞরা ১৮ বছরের আগে কোনো শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দেয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে এই পরামর্শের প্রতি আমাদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। অনেক অভিভাবক সস্তানদের আবদার রক্ষার্থে তাদেরকে দামি ও সুন্দর স্মার্টফোন এবং মোটরসাইকেল কিনে দিচ্ছেন।

শিশুদের কল্যাণ, সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘শিশু আইন, ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীতে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে শিশু আইন যুগোপযোগী করা হয়। এই আইন অনুযায়ী শিশুদের অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত ও বিচার করতে হবে। অভিযুক্ত শিশুদের বিচারের জন্য বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় শিশু আদালত রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে শিশু আদালতের দায়িত্বে রয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার মামলা শিশু আদালতগুলোতে বিচারাধীন। শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী শিশুদের বিচারের ও আদালতে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো নির্দেশনা রয়েছে। জেলা সমাজসেবা অফিস, প্রবেশন কর্মকর্তা ও প্রত্যেক থানায় শিশু ডেস্কে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত শিশুকে নিয়ে আইনের আলোকে দায়িত্ব পালন করেন। অভিযুক্ত শিশুদের কাজ করার জন্য অনেকগুলো সেইফ হোম ও কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। অভিযুক্ত শিশুরা মূলতঃ জামিনের আগ পর্যন্ত ওই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করে। তাদের মানসিক উন্নয়ন এবং অপরাধ থেকে ফেরাতে কেন্দ্রগুলোতে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তারাই ভবিষ্যতে এ জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। এটা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত একটা বাক্য, যার বিপরীতে আমাদের করণীয় কী, একথা আমরা অনেকেই জানি না। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চর্চায় শিশু অধিকারের বিষয়গুলো এখনো অনেকখানি উপেক্ষিত। আমাদের অনেকেরই ধারণা, শিশুরা যেহেতু বয়সে ছোট, তাদের দাবি আদায়ের ক্ষমতাও কম। তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ অল্প। তাদের মৌলিক অধিকারগুলো তুলনামূলক কম লাগে বলে, তাদের সামাজিক মর্যাদা তুলনামূলক ছোট। আর এই মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নে আমাদের তেমন কোনো জবাবদিহি নেই। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়।

বাংলাদেশের অনেক শিশুর পরিবার খুবই দরিদ্র। এই দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মধ্যে রয়েছে শ্রমজীবী শিশু, গৃহকর্মী, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, বাল্যবিবাহের শিকার শিশু এবং চর, পাহাড় আর দুর্গম এলাকায় বসবাসরত শিশু। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এসকল প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কেন না, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে আইনকানুন ও নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। আমাদের শিশুনীতি, শিশু আইন, শিশুশ্রম নিরসন নীতি, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পাচার প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে শিশুদের সুরক্ষামূলক আইন রয়েছে, যা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাজের সমন্বয়ের জন্য দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী শিশুর ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন বেড়েছে। এটা প্রতিকারে আইনি অনেক বিধান থাকলেও এই ধরনের কর্মকা- প্রতিরোধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামোর মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো বাজেটে শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা। বাংলাদেশে এখন শিশুদের জন্য ‘শিশু বাজেট’ নামে যে চর্চাটি রয়েছে, তা শিশুদের চাহিদা পূরণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেন না, এই শিশু বাজেট মূলতঃ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের একটি সামগ্রিক চিত্র মাত্র। এতে করে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুর চাহিদাকে মাথায় রেখে তাদের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও বাজেট করা হয় না। তাই এই বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় শিশু এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি সংগঠনগুলোর মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচারসহ শিশু অধিকার লঙ্ঘনের নানা বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে গণমাধ্যমসহ সামাজিক সংগঠনগুলো বারবার বলে আসছে। এ বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

তবে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিশু সুরক্ষা বিষয়ক চেতনাগত পরিবর্তন দরকার। পরিবার ও স্কুলগুলোতে এখনো শাসনের নামে শারীরিক নির্যাতনের প্রচলন রয়েছে, যা শিশুর বিকাশে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি পরিপত্র থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়। সময় এসেছে শিশু নির্যাতন মেনে নেয়ার বা চুপ থাকার সংস্কৃতি ভাঙার। এ জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। যেখানে সংবাদমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংগঠনগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। আর সে জন্য দরকার এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা ও যথাযথ উদ্যোগ।
শিশুর প্রতি শুধুমাত্র চিকিৎসাসেবাই সেবা না, কিছু আনুষঙ্গিক করণীয়ও শিশু যত্নের একটি অংশ। শিশুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সহায়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো শিশুর যত্ন ও আচরণগত উন্নয়নে সহায়ক হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১) নবজাতকের জীবন সুরক্ষা:
প্রান্তিক পর্যায়ে গর্ভধারণকালে মায়ের ৪টি স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি হাসপাতালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতিতে সন্তান প্রসব নিশ্চিত খুবই জরুরি। নবজাতকের আবশ্যিক যত্ন কীভাবে নিতে হয় সেদিকে দৃষ্টি প্রদানও জরুরি।

২) জীবন রক্ষায় পরিচ্ছন্নতা:
মৌলিক পরিচ্ছন্নতা পালনে বাংলাদেশের মানুষ বেশ পিছিয়ে, বিশেষকরে সঠিকভাবে হাত ধোওয়ার চর্চায়। অথচ এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই, টয়লেটের পর, বাচ্চা পায়খানা করলে তাকে পরিষ্কার করানোর পর এবং শিশুকে খাওয়ানোর আগে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়ার প্রয়োজনীয়তা অতিগুরুত্বপূর্ণ।

৩) শিশুর সঠিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা:
বাড়ন্ত সময়ে আবশ্যিক পুষ্টির অভাবে শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। বাংলাদেশ থেকে এই সমস্যা দূর করতে জন্মের প্রথম ৬ মাস যেন শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো হয় এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি জরুরি এবং এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ছয় মাস পরে বুকের দুধের সঙ্গে ফল, শাকসবজি আর প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ ডিম, মাংস খাওয়ানো শুরু করতে হবে।

৪) সময়মতো জন্ম নিবন্ধন:
জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যেই শিশুর জন্ম নিবন্ধন সেরে সনদটি সংরক্ষণ করে রাখতে বাবা, মা এবং অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

৫) শৈশবের পরিচর্যা ও বিকাশ:
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর জন্য বাড়িতে শিক্ষনীয় পরিবেশ তৈরি ও শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করার দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। শিশুকে খেলনা দেয়া, তাদের সঙ্গে কথা বলা ও খেলাধুলা করা, ভালো আচরণের প্রশংসা করতে হবে। মা, বাবা ও অন্যদের এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ (আরলি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট) এর জন্য এটা খুবই গুরুত্ব বহন করে।

৬) মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা:
ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, ছয় বা তার বেশি বয়সী শিশুকে যেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে তার লেখাপড়া চালিয়ে নেয়া হয় সে জন্য বাবা-মাকে উৎসাহিত করতে হবে। একইসঙ্গে মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব ও অন্যান্য মৌলিক বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা জরুরি।

৭) শিশুর ওপর সহিংসতা রোধ:
স্কুল ও বাসায় যাতে শিশুর সঙ্গে ইতিবাচক আচরণ করা হয় তা নিশ্চিতে শিক্ষক ও বাবা-মায়েদের সচেতন হতে হবে।

৮) বাল্যবিবাহ বন্ধ:
বয়স ১৮ হওয়ার আগে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ে এবং সন্তান জন্মদানের উপযুক্ত হয় না সে বিষয়ে কিশোর-কিশোরীসহ তাদের অভিভাবক এবং কমিউনিটি সদস্যদের সচেতন থাকতে হবে। শিশুর বিয়ে আয়োজন এবং তাতে অংশগ্রহণ না করতে লোকজনদের উৎসাহিত করা। ক্ষতিকর এই কাজের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কমিউনিটি সদস্যরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন সে বিষয়গুলোও তাদের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।

৯) কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষার সুযোগ:
লেখাপড়া অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে ছেলে-মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে তাদের বাবা-মা এবং কমিউনিটি সদস্যদের উৎসাহিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি তারা যাতে ঝামেলাহীনভাবে শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারে তার অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও নিশ্চিত করতে হবে।

১০) বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা:
কিশোর-কিশোরীদের ঋতুকালীন পরিচ্ছন্নতা, যথাযথ পুষ্টি, এইচআইভি/এইডস থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি খুবই প্রয়োজনীয়। এ বিষয়ে তাদের মা-বাবাদের সচেতন থাকতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, শিশুর সুরক্ষায় বাংলাদেশে প্রচলিত আইনগুলোর পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ দেখানো হয়েছে বিদ্যমান বিভিন্ন আইনে শিশুর বয়স নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা যা শিশুর সুরক্ষা ও উন্নয়নে জটিলতা সৃষ্টি করছে। তাই শিশুদের জন্য প্রচলিত আইন ও নীতিমালাগুলোর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। আর শিশুদের বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি ও অসঙ্গতি দূর করা, শিশুর সার্বজনীন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা, বিয়ের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক বয়স নির্ধারণ না করা, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ ছাড়াও শিশু আইন ২০১৩ এর আলোকে অনতিবিলম্বে বিধিমালা প্রণয়ন করা, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় শিশুবান্ধব আদালত প্রতিষ্ঠা করা, শিশুশ্রমিক নিয়োগকারীদের জন্য শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা, শিশু আইন ২০১৩ এ শারীরিক শাস্তির পাশাপাশি শিশুর মানসিক শাস্তির বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *