শিশুদের প্রতি অসংবেদনশীল আচরণ কেন?

ঢাকায় খেলার মাঠে খেলতে চাওয়ার জন্য শিশুদের কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নির্বাচনী সহিংসতার সময় শিশুর ঘাড়ে রামদার কোপ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই শিশুটি প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীর ভাতিজা বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে। ঢাকায় যারা শিশুদের কান ধরে ওঠবস করিয়েছেন, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আর যারা সাতকানিয়ায় হত্যাকারী, তারা সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীর অনুসারী। এর বাইরেও তাদের পরিচয় হচ্ছে, তারা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক এবং হয়ত কোনো শিশুর পিতাও। শুধু এ দুটি ঘটনার কথাই কেন বলছি। প্রায়ই শিশু গৃহকর্মী নির্যাতন, হত্যার খবরও সংবাদমাধ্যমে আসে। যারা নির্যাতক তাদের অধিকাংশই দায়িত্বশীল পেশায় কিংবা পদে আছেন এবং তারা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার জন্য যতটা সংবেদনশীল হওয়ার কথা, তারা ততটা নন, কিংবা তাদের ভেতরে সংবেনশীলতার নূন্যতম শিক্ষাও নেই। সভ্যতাবোধের বিষয়টি তো আরও অনেক পড়ে!

একটা জাতির সভ্যতার বড় মাকাঠি হচ্ছে শিশুর প্রতি আচরণ। অস্ট্রেলিয়ার আইনে বাবা-মাও যদি শিশুদের কটূবাক্য প্রয়োগ করেন এবং সেটার খবর যদি পুলিশের কাছে পৌঁছে, তাহলে সেই বাবা-মাকে আইনগত শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। সুইডেনে শিশুর মনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এমন আচরণ কেউ করলে সেটিও কঠোর অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। বিশ্বের শিক্ষিত, সংবেদনশীল দেশগুলোতে শিশু অধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আর ঢাকায় আমরা কী চিত্র দেখলাম? থানা ভবন নির্মাণের জন্য একটি জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে সরকারের সংশ্নিষ্ট দপ্তর। সেই জায়গাটি শিশুদের খেলার মাঠ। আর এই মাঠে শিশুরা খেলার অধিকার চেয়েছে বলে পুলিশের সদস্যরা তাদের কান ধরে ওঠবস করিয়ে সেটা ভিডিও করেছেন! এর অর্থ পরিষ্কার পুলিশের এই সদস্যদের শিশুদের সঙ্গে আচরণের কোনো পেশাগত প্রশিক্ষণই ছিল না। থাকলে তারা এই আচরণ করতে পারতেন না। যদিও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করেছেন। কিন্তু এখানেই কী সব শেষ হয়ে যায়? এই পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দিয়ে হয়ত ওই শিশুদের এবং তাদের অভিভাবকদের সান্ত্বনা দেওয়া যায়, কিন্তু বাস্তবে সমস্যা থেকেই যায়। এর আগে শিক্ষার্থীরা যখন নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলনে নেমেছিল, তখনও শিশুদের প্রতি অসংবেদনশীল আচরণ থেকে শুরু করে হামলার ঘটনা পর্যন্ত চোখে পড়েছে।

অতএব কোনো ঘটনা ঘটলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি শিশুদের প্রতি সংবেদনশীল আচরণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সবচেয়ে জরুরি। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের এই প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা দরকার। কারণ তাদেরই দায়িত্ব কোথাও শিশু অধিকার লঙ্ঘিত হলে কিংবা শিশুদের প্রতি অসংবেদনশীল আচরণ হলে, তা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার। তারাই যদি শিশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, তা না জানেন, তাহলে তারা শিশুদের রক্ষা করবেন কীভাবে?

আরও অবাক করার বিষয় হচ্ছে, শিশুদের খেলার মাঠ থানা ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে সরকারের সংশ্নিষ্ট দপ্তর। সেই দপ্তরের যারা দায়িত্বে, তারাও তো প্রাপ্তবয়স্ক এবং নিশ্চিতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিগ্রিধারী। অথচ তারা শিশুদের খেলার মাঠ বরাদ্দ দেওয়ার আগে শিশুদের কথা একবারও ভাবেননি। এই দায়িত্বশীলরাও কী শিশুদের সঙ্গে অসংবেদনশীল আচরণ করেননি? একটা খেলার মাঠে যখন ভবন হয়, তখন অন্য খেলার মাঠগুলোও আরেকটি ভবন নির্মাণের জন্য পথ করে দেওয়া হয়। তাহলে কি যে কয়েকটি খেলার মাঠ আছে, সেগুলোও একে একে ভবনের পেটে শেষ হয়ে যাবে?

সাতকানিয়ায় নির্বাচনী সহিংসতায় অংশ নিয়ে যারা শিশু হত্যা করেছেন, তারা কোন ধরনের রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী? কীসের জন্য রাজনীতি করেন তারা? সেই রাজনীতি তাদের কী শিক্ষা দিয়েছে? শিশুদের অধিকার নিয়ে যখন কথা বলা হয়, তখন বেশকিছু কেতা দুরস্ত শিক্ষিত দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুখ-চোখ শক্ত করে বেশ জ্ঞানও দিয়ে থাকেন। একজনের যুক্তি, শিশু মানেই কিন্তু একেবারে অবুঝ, সহজ সরল নয়। চৌদ্দ-পনের বছর বয়সীরা এখন নানা ধরনের ক্রাইম করছে, তাদের ব্যাপারে কী করবেন? কিশোর গ্যাং-এর নাম শোনেননি? তাদের তো সংশোধন কেন্দ্রে পাঠালেও দোষ?

কী অদ্ভুত! এই দায়িত্বশীলরা একবারও ভাবেন না, চৌদ্দ-পনের বছরের শিশু-কিশোররা গ্যাং তৈরি করে কীভাবে, কাদের সমর্থনে? তার তো স্কুলে যাওয়ার কথা, পড়া-লেখায় ব্যস্ত থাকার কথা! আসলে এই অবুঝ শিশু-কিশোরদের গ্যাং-এর সদস্য বানিয়ে ফেলেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। এটা ওপেন সিক্রেট। কারণ এদের কম খরচে খুব সহজে নিজের ইচ্ছেমত ব্যবহার করতে পারেন এইসব নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতারা। যদি কিশোর গ্যাং নির্মূল করতে হয়, তাহলে তাদের সংশোধানাগারে না পাঠিয়ে তাদের গ্যাং হিসেবে তৈরি করছে যারা, তাদের ধরা দরকার।

এই গ্যাং গডফাদারদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ সংশোধনাগারগুলোর চিত্রও আমরা জানি। সেখানেও প্রাপ্ত বয়স্ক দায়িত্বশীল তত্ত্বাবধায়কদের হাতে শিশুরা নানা ধরনের নির্যাতন, অপরাধের শিকার হয়ে বিদ্রোহ করছে, এমন খবরও তো প্রায়ই প্রকাশ হচ্ছে। অতএব নেতা নামধারী গ্যাং গডফাদারদের ধরুন। তাদের জন্য প্রয়োজনে আলাদা সংশোধানাগার তৈরি করুন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই গ্যাং গডফাদাররা সবসময়ই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ কারণে একটা গ্যাংকে ধরে সংশোধনাগারে পাঠানোর পর আরেকটা গ্যাং তৈরি হচ্ছে গড়ফাদারদের তত্ত্বাবধানে। আসলে আমাদের সন্তানরা যদি কিশোর বয়সেই বখাটে হয়ে যায়, সে দায় তাদের নয়, বরং অভিভাবক হিসেবে আমি, আপনি, আমাদের লজ্জা, আমরাই দায়ী।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ- এটা আমাদের দেশে নিছক একটি কেতাবি বাক্য। বাস্তবে আমরা আমাদের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবি না। কেউই ভাবি না, একেবারেই ভাবি না। এ কারণেই আমাদের সন্তানদের খেলার মাঠে গিয়ে কান ধরে ওঠবস করতে হয়। বাবার সঙ্গে বের হয়ে প্রতিপক্ষের হাতে লাশ হতে হয়, একবেলা খাওয়ার জন্য কারও বাসায় কাজ করতে গিয়ে খুন্তির ছ্যাঁকা খেতে হয়, কিশোর বয়সে বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে গ্যাং গডফাদারের খপ্পরে পড়তে হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে জাতীয় রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতির খেলার পুতুলে পরিণত হতে হয়, কখনও কখনও মার খেয়ে মরে যেতে হয় বন্ধুদের হাতেই। তারপর তারা যখন কর্মজীবনে দায়িত্বশীল হয়, তখন তারাও ভীষণ অংসবেদনশীল, অসভ্য আচরণেরই নজির স্থাপন করে। আপনি-আমি, আমরা আসুন নিজেদের বুকে হাত দিয়ে একবার ভাবি, আমি, আপনি, আমরা কী সভ্য? না হলে সভ্য হব কবে, কীভাবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924