শিক্ষার নামে শিশু নির্যাতন বন্ধ করুন
রাষ্ট্র তো বৃহত্তর সমাজ বটে, যার নেতৃত্বে থাকে সরকার। অর্থাৎ নীতি, আইন ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসারে পরিচালিত ছোট-বড় নানা প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত কাঠামো। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারিক স্তরে নাগরিকের সাধারণ আচার-আচরণের প্রতিফলন ঘটার কথা। যেহেতু ব্যবস্থার উদ্দেশ্য থাকে সরকার, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রতিনিধি ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের পথ ও পন্থা উন্মুক্ত রাখা। বড়ই পরিতাপের বিষয়, এ দেশে জনগণের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সম্বন্ধ শাসিত ও শাসনযন্ত্রের সম্বন্ধ। নিয়ন্ত্রিত ও নিয়ন্ত্রকের সম্বন্ধ। বিশেষ করে, শিশু নাগরিকদের প্রতি প্রতিষ্ঠানের আচরণ ভয়ংকর নিয়ন্ত্রকের।
ইউনিসেফের হিসাবমতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শিশু। বিপুলসংখ্যক শিশু এখানে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রস্ত জীবন যাপন করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলে থাকেন, শিশুদের আচরণ সংশ্নিষ্ট পরিবারগুলোর পারিবারিক সংস্কৃতির প্রতিফলন। তত্ত্বগতভাবে পরিবারকে প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করাও হয়। দুঃখজনক, শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পরিবারেও টিকে রয়েছে প্রথাগত ‘শাসন’ ব্যবস্থা। সন্তান ‘মানুষ’ করার পথ বলতে এখানে ‘শাসনের মধ্যে’ রাখাই বোঝায়! তাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে বিশ্বজনীন সংবিধান এবং একটি জাতীয় শিক্ষানীতি থাকা সত্ত্বেও শিশু নির্যাতন ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, পরিবারের বাইরেও এমন কোনো স্থান আর অবশিষ্ট নেই যেখানে শিশুরা খেলবে, বন্ধুদের সঙ্গে মিথস্ট্ক্রিয়ার মাধ্যমে মানসিকভাবে পরিপকস্ফ হতে থাকবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিকশিত হবে, সম্পর্ক স্থাপন করবে অপরাপর প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে। নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় পরিবারও চায় শিশু পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের ঘরেই থাকুক। কিন্তু ঘরে আটকে রাখার সক্ষমতা সিংহভাগ পরিবারের নেই। তাই পরিণতি যাই হোক, পরিবার চায় শিশু কিছু না কিছুতে ‘এনগেজড’ থাকুক।
হাটহাজারীর ৮ বছরের শিশু ইয়াসিনের মা-বাবাও চেয়েছিলেন ছেলে হাফেজি পড়ূক আবাসিক মাদ্রাসায় থেকে। সেখানকার ইয়াহিয়া হুজুর কর্তৃক ৮ বছরের ইয়াসিনের ওপর পাশবিক প্রহারকাণ্ডের ভিডিও দেখেও তার মা-বাবা মামলা করতে আগ্রহ বোধ না করার কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘ছেলেকে হাফেজি পড়াইতে চাই আমরা। সে তো ওইখানে পড়বে, তাইলে মামলা করে কী হবে? উল্টা শিক্ষকের জীবনটা নষ্ট হবে।’ ইয়াসিনের বাবার এই মনোভাব শিশু নির্যাতন অপরাধকে স্বাভাবিক হিসেবে এবং শিশু নির্যাতনকারীর জীবনকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখার অস্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ ঘটনার উল্লেখ করে বিবিসি বাংলায় প্রকাশ, ‘বাংলাদেশের আবাসিক মাদ্রাসাগুলোতে প্রায়ই শিক্ষকের হাতে শিক্ষার্থীর নির্মম মারধরের শিকার হতে হয়, এমন অভিযোগ রয়েছে। এমনকি শিক্ষার্থীরা অনেক সময় শারীরিক নিপীড়ন ও বলাৎকারের শিকার হয়, এমন অভিযোগও শোনা গেছে। তবে এসব অভিযোগের প্রেক্ষাপটে মামলা দায়ের কিংবা শাস্তি পাবার ঘটনা প্রায় কখনোই শোনা যায় না।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব রকম শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হলেও সে নিষেধ অমান্য করার অপরাধে কোনো মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির বিরল বটে। দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য এক স্বাভাবিক ঘটনা। শিশুদের কথা শোনানোর জন্য ধমক দেওয়া, বল প্রয়োগ করা ও প্রহার করা জায়েজ কর্ম হিসেবে বিবেচিত! কেননা, শিশুরা দুর্বল এবং বয়স্করা সবল। ফলে শিশু নির্যাতন, শিশুশ্রম, শিশু ধর্ষণ অবাধে চলতে থাকে।
এমন একটা সমাজে আমরা বসবাস করি, যেখানে দুর্বল মানেই মান্যবরের দাস। মান্যবর হয়ে ওঠে তারাই, যাদের থাকে ক্ষমতার বর্ম, পুঁজির শক্তি এবং ধর্মের ঢাল। যাদের এসব কিছুই থাকে না, তারা শিশু কিংবা নারী, অথবা দরিদ্র যাই হোক, তাদের থাকতে হয় নিরন্তর ভয়ের সংস্কৃতির ভেতরে গুটিয়ে। গুটিয়ে থাকতে থাকতেই শিশুরা বড় হতে থাকে আত্মবিশ্বাসহীন ভীত হরিণের মতো। ইয়াসিনের মা-বাবা হয়তো এ কারণেও মামলা করতে আগ্রহী নন, মামলার পথ বড় বেশি দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর। হয়তো তাই সিংহভাগ মানুষের মতো ইয়াসিনের মা-বাবাও পরিস্থিতি মেনে নেওয়াকেই নিরাপদ ভাবেন। অথবা ওই প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর বাইরে সন্তানের শিক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য তাদের চিন্তাজগতে আর কোনো বিকল্প নেই! বৃহত্তর সমাজ সংকুচিত হতে হতে অন্ধকার কুয়োয় পরিণত হলেই কেবল চিন্তাজগৎ এতটা ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের শিশুদের সুরক্ষার দায়িত্ব কেবলই মা-বাবার অযৌক্তিক বিশ্বাস ও হতাশার ওপর ছেড়ে দেওয়া প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ নিশ্চয়। ব্যক্তি হিসেবে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রশংসা করতে হয়। কেননা, তিনি ওই নির্যাতিত শিশুর মা-বাবাকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মামলা করাতে পেরেছেন। তাতে প্রতিষ্ঠানের মান কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু এভাবে আশ্বস্ত হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। করোনা পরিস্থিতি থেকে জনগণকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর সরকার সব রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। তার মধ্যে এই আবাসিক মাদ্রাসাগুলো খোলা থাকতে পারছে কীভাবে- সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
পরিস্কার জানি না, বিশেষ বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আইন ও সরকারি নির্দেশনা ভিন্ন কিনা; কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শাস্তিদানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত কিনা এই মাদ্রাসাগুলো। একই দেশে নীতির দুই রকম প্রয়োগ সার্বিক অশান্তি ছাড়া আর কিছুই দেবে না, বরং বাঙালির জাতিগত বিভাজন স্পষ্ট করবে। এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় রকমফেরের বিশৃঙ্খলা রয়েছে। সরকারি প্রাথমিক, বেসরকারি প্রাথমিক, কিন্ডারগার্টেন, ইংলিশ ভার্সন, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। অনেকটি স্বাধীন বোর্ডের অধীন নানা মত ও নেতৃত্বের কওমি মাদ্রাসা, বিভিন্ন দেশের পাঠ্যক্রম অনুসারে পরিচালিত বিচিত্র ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, শত শত এনজিও পরিচালিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, সরকারের ‘সেকেন্ড চান্স’ শিক্ষা কার্যক্রম ইত্যাদি। শিক্ষায় এত বিভেদ চলতে দিয়ে কীভাবে সম্ভব ঐক্য-চিন্তাসম্পন্ন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের বাস্তবায়ন? কীভাবে সম্ভব বৈষম্যমুক্ত সাম্যের বাংলাদেশ?
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলেন, নির্যাতন ও ভয়জনিত অবদমনের ভেতর দিয়ে বড় হয়ে ওঠা শিশুরা সহিষ্ণুতা অর্জন করতে পারে না। তারা হয়ে পড়ে আত্মবিশ্বাসহীন। সম্ভাবনা থাকে তাদের মধ্যেও সহিংস আচরণ প্রকাশ পাওয়ার। এমনিতেই খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং কোনোরূপ সামাজিকীকরণমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকাই তো শিশুদের নির্যাতিত বোধ করার জন্য যথেষ্ট। এ রকম শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে কোনোমতে বেড়ে ওঠা শিশুদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের এক একটি ঘটনার বিচার সমাধানের সঠিক পথ হতে পারে বলে মনে হয় না। প্রয়োজন ব্যবস্থার যথাযথ পরিবর্তন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন তেমন সহায়ক পরিবেশ, যেখানে ভয়শূন্য চিত্তে সংবেদনশীল মানসিকতা নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে আমাদের সন্তানরা।
কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক