দেশে করোনায় এতিম হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার শিশু

ল্যানসেট-এর গবেষণালব্ধ ফলাফল ব্যবহার করে ‘কোভিড-১৯ অরফানহুড টুল’ তৈরি করেছে ইমপিরিয়াল কলেজ অব লন্ডন। সেখানে প্রতিটি দেশে করোনায় এতিম হওয়া শিশুদের আনুমানিক তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই টুলে দেশগুলোর করোনায় মৃত্যুর তথ্য নেওয়া হয়েছে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর দেশগুলোর প্রজননহার নেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের জনসংখ্যার বৈশ্বিক তথ্য থেকে।

কোনো শিশুর মা-বাবার একজন অথবা দুজনই মারা গেলে সে শিশুকে এতিম ধরা হয়েছে। মা-বাবার পাশাপাশি অভিভাবকসুলভ দাদা-দাদি, নানা-নানিকে প্রত্যক্ষ পরিচর্যাকারী হিসেবে ধরা হয়েছে। আর পরিবারে বসবাসকারী দাদা-দাদি, নানা-নানি অথবা ৬০ থেকে ৮৪ বছর বয়সী কোনো আত্মীয়কে পরোক্ষ পরিচর্যাকারী বিবেচনা করা হয়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল বলেন, করোনায় এতিম হওয়া শিশুদের পরিবারগুলোকে এসব শিশুর বিশেষ যত্ন নিতে হবে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নও নিতে হবে। আর রাষ্ট্রেরও এই শিশুদের জন্য কী করণীয়, তা দ্রুত ঠিক করতে হবে। এতিম শিশুদের এমনিতে সামাজিক দক্ষতা ও উৎপাদনক্ষমতা কমে যায় বলে জানান তিনি।

বিশ্বে এতিম হয়েছে ১০ লাখের বেশি শিশু

২০২০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২১টি দেশের করোনাসংশ্লিষ্ট মৃত্যুর তথ্য নিয়ে ল্যানসেট-এর গবেষণাটি করা হয়েছে। বিশ্বে করোনায় মোট মৃত্যুর ৭৭ শতাংশ হয়েছে এই দেশগুলোয়। গবেষণায় ১৮ বছরের কম বয়সীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পরিচর্যাকারীর করোনাসংশ্লিষ্ট মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। গবেষণায় সহায়তা করে ইউকে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন, ইউকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ রিসার্চ, ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ এবং ইমপিরিয়াল কলেজ লন্ডন।

শিশুদের পরিচর্যাকারী হিসেবে দাদা-দাদি, নানা-নানিদের গুরুত্ব বেশি। দাদা-দাদি, নানা-নানিরা শিশুদের সঙ্গে থাকেন, সারা বিশ্বে এমন পরিবার ৩৮ শতাংশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এমন পরিবার প্রায় ৫০ শতাংশ। ‍যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রেই দাদা-দাদি, নানা-নানি প্রত্যক্ষ পরিচর্যাকারী। করোনায় এমন পরিচর্যাকারীদের মৃত্যুও শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি ১ হাজার শিশুর বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ১০টি শিশু এতিম হয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রতি ১ হাজারে ৫টি শিশু, মেক্সিকোতে ৩ দশমিক ৫, ব্রাজিলে ২ দশমিক ৪, কলম্বিয়ায় ২ দশমিক ৩, যুক্তরাষ্ট্রে ১ দশমিক ৫ এবং রাশিয়াতে ১টি শিশু মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়েছে।

অধিকাংশ শিশু এতিম হয়েছে কমবয়সী এবং মাঝবয়সী বাবাকে হারিয়ে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের মৃত্যু বেশি শিশুকে এতিম করেছে। নারীদের ক্ষেত্রে এই বয়স ১৫ থেকে ৪৪-এর মধ্যে। করোনায় মা, বাবা ও অভিভাবকের মৃত্যু শিশুর জীবনকে স্থায়ীভাবে বদলে দিয়েছে। শিশুর অভিভাবকের এই মৃত্যুর বিষয়টিতে বৈশ্বিক সাড়া দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মানসিক ধাক্কা লেগেছে শিশুদের

অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার মহিবুল্লাহ বাহারের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পরেছেন তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাহারের বড় ভাই মোকাররম হোসেন  বলেন, বাহার চলে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ হওয়ার নয়। বাহারের মৃত্যুর আগে ওর ছেলেটা একদম ফুটফুটে ছিল। গত কয়েক মাসে ছেলেটা একদম শুকিয়ে গেছে। বাবার অভাব বুঝতে পারে ছেলেটা। অর্থনৈতিকভাবেও কিছুটা কষ্টে পড়েছে তারা।

দৈনিক সময়ের আলো পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক ছিলেন মাহমুদুল হাকিম। গত ৬ মে তিনি মারা যান। মাহমুদুলের বড় ছেলে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী আর ছোট ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। মাহমুদুল ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুতে পুরো পরিবার দিশেহারা।

মাহমুদুলের স্ত্রী আরিফা সুলতানা  বলেন, ছেলেগুলো স্বাভাবিক হতে পারছে না। বাবা ছিলেন ওদের বন্ধুর মতো। পড়তে বসলে, খাবারের টেবিলে সব সময় বাবাকে নিয়েই কথা বলে। এখন সংসার চলছে তাঁর মা-বাবার সহায়তায়।

গত ১৬ এপ্রিল সকালে সন্তানের জন্ম দেন একাত্তর টেলিভিশনের সহযোগী প্রযোজক রিফাত সুলতানা (৩০)। সেদিন বিকেলেই করোনায় আক্রান্ত রিফাত সবাইকে ছেড়ে চলে যান। রিফাতের যমজ সন্তানদের বয়স তিন বছর হয়েছে গত জুন মাসে।

রিফাতের স্বামী নাজমুল ইসলাম বলেন, জীবন তো থেমে থাকে না। পরিবারের সদস্যরা মিলে বাচ্চাদের দেখভাল করছে। যমজ বাচ্চা দুটো সময়ে-সময়ে মাকে খোঁজে।

পারিবারিক দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে শিশুরা

বগুড়া শহরের নাটাইপাড়া এলাকার বাসিন্দা মতিউর রহমান ছিলেন একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অফিস সহকারী। গত সেপ্টেম্বরে তাঁর চাকরি চলে যায়। তাঁর স্ত্রী মায়িশা ফারাহ্ ছিলেন একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। গত বছরের মার্চ থেকে তিনিও বেকার। সংসার চালাতে মতিউর রহমান ইজিবাইক চালানো শুরু করেন। কিন্তু গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর করোনায় মারা যান মতিউর। পাঁচ ও আড়াই বছর বয়সী দুই শিশুকন্যা এবং বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মায়িশা ফারাহ্। সংসার চালাতে এখন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ নিয়েছেন। কিন্তু এই উপার্জনে কীভাবে সংসার সামলাবেন, সেটা নিয়েই কপালে চিন্তার ভাঁজ। মায়িশা বলেন, করোনায় স্বামীকে হারানোর পর সংসারে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে।

ল্যানসেট-এর প্রবন্ধে বলা হয়, যেসব শিশুর বাবা অথবা মা মারা যাচ্ছেন, সেসব শিশুর পারিবারিক দারিদ্র্যের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা বেশি। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছে, এমন ১০টি পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। এসব পরিবার মৃত ব্যক্তির সন্তানের ভবিষ্যৎ ও পড়ালেখা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে।

আইরিনা খাতুনের (১৯) বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার কিশোরপুর গ্রামে। আইরিনা দুর্গাপুর উপজেলার দাওকান্দি কলেজে সম্মান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর বাবা আবদুল মালেক (৬০) গত ২৫ জুলাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। আবদুল মালেক ছোট্ট একটা মুদিদোকান চালাতেন। সেটিই তাঁদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল।

গত ২১ জুন আইরিনা তাঁর করোনায় আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে রাজশাহী মেডিকেলে আসেন। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকে দোকানটি বন্ধ। আইরিনা জানান, বাবাকে হাসপাতালে ভর্তির পরদিনই তাঁর মা মহসিনা বেগমও (৪৫) করোনায় আক্রান্ত হন। তাঁদের পরিবারের কোনো সঞ্চয় ছিল না। কিছুতেই মা-বাবার চিকিৎসার ব্যয় সংকুলান করতে পারছিলেন না। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগের দিনই পোষা হাঁসগুলো সব বিক্রি করে দিতে হয়েছিল।

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার বাসিন্দা মো. সুলতান (৩৬)। বাড়ির পাশে ছোট মুদিদোকান চালাতেন। বড় মেয়ে দশম শ্রেণিতে আর ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। গত ১১ জুন এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় সুলতানের। পরিবারে আয়ের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তির মৃত্যুতে কষ্টে পুরো পরিবার। স্বামীর চিকিৎসার খরচ জোগাতে মুদিদোকানের পুঁজিও শেষ হয়েছে, পণ্য না থাকায় দোকানের বিক্রিও গেছে কমে। আস্তে আস্তে অর্থসংকটে পড়ছে পরিবারটি।

এতিম শিশুদের জন্য করণীয়

করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, শনাক্তের পাশাপাশি আরেকটি বিষয় জরুরি, সেটি হচ্ছে শিশুদের যত্ন। যেসব পরিবারের মা-বাবা মারা গেছেন, সেসব পরিবারকে মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা দিলে তা এতিম শিশুদের গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। মানসিক সহায়তা, মানসিক আঘাতকেন্দ্রিক থেরাপি, যোগাযোগ—এসব শিশুর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

শিশুদের জন্য প্রয়োজন ‘শিশু হেলপ লাইন’ সার্বক্ষণিক চালু রাখা। মেয়েশিশুরা যেন বাল্যবিবাহের শিকার না হয়, অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংগঠন, দাতা গোষ্ঠী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে এ ইস্যুতে একসঙ্গে কর্মসূচি নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *