ডেঙ্গু কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের
আমরা দুই বছর আগেও করোনার কত বিধিনিষেধ মেনে চলেছি, প্রায় ধর্মীয় রীতির মতো করে। সে জীবাণু ছিল অসম্ভব সংক্রামক। তারপরও বাঙালি জাতি এ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সরকার টিকা যেমন এনেছে, তেমনি দরিদ্র মানুষকে থোক টাকা, ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিয়েছে। এভাবে জনবহুল ছোট্ট দেশটিতে করোনায় মৃত্যু বিদেশের তুলনায় ছিল অনেক কম। অফিস-আদালত, দোকানপাট খুললেও করোনার বিধিনিষেধ মানা হয়েছে কঠোরভাবে। ‘হাত ধোওয়া’ তো মনে হয় নতুন দৈনন্দিন রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। করোনা আক্রমণ করেছিল বয়স্ক ও তরুণ বয়সীদের। আমাদের সৌভাগ্য, শিশুরা এর তেমন শিকার হয়নি।
এখন হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগীদের ভিড়। আমরা হারাচ্ছি আমাদের আদরের শিশুদের, যাদের মৃত্যু অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ডেঙ্গু রোগ সংক্রামক নয়। অথচ আমরা একটা ক্ষুদ্র এডিস স্ত্রী মশার হাতে শিশুদের এমনকি অনেক বড়দেরও আক্রান্ত হতে দেখছি। এর মধ্যে ডাক্তারকেও মারা যেতে দেখলাম। আরও বেশি দেখছিÑ শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা মারা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।
কদিন আগে টিভিতে ডা. লেলিন চৌধুরীকে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন করতে দেখেছি যে, বাবা, মা তাদের ছেলে এবং মেয়ে দুটি সন্তানকেই ডেঙ্গুতে হারিয়েছে, কেউ তাদের দুঃখে সহমর্মিতা দেখাতে গেল না কেন? এই বাবার ছবির সঙ্গে ছেলে ও মেয়ে দুজনের ছবি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় দেখে খবরটি পড়ে চোখের জল বাঁধ মানেনি। ভাবছিলামÑ মেয়র, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, এলাকার জনপ্রতিনিধি তাদের খোঁজ-খবর নেবেন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক, শিশু সংগঠনগুলোরও সন্তান হারা বাবা-মাকে সঙ্গ দিতে যাওয়া উচিত ছিল। স্কুলের শিক্ষার্থী মারা গেছে অনেক। তাদের বাড়িতে স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষকরা, সহপাঠীরা আশা করি গেছে এবং শোকার্ত বাবা-মার সঙ্গে দেখা করেছে।
এত মৃত্যু, তাও আবার শিশুদের, মনে হয় না এ দেশে আগে কখনো ঘটেছে। যে কোনো বাড়ি এবং বাবা-মার আনন্দের উৎস, ভরসার স্থল এবং বেঁচে থাকার বড় উৎসাহ তাদের শিশুরা। তাদের কেন্দ্র করে বাবা-মা, দাদা, দাদি, নানা, নানিদের জীবন ধারণের প্রায় সবরকম কাজকর্ম সংঘটিত হয়। জানি না, মিরপুরের ওই পুত্র ও কন্যা দুই সন্তানকে একত্রে ডেঙ্গুর কাছে হারিয়ে কি বলে প্রবোধ তাদের দেওয়া যায়! কিভাবে সহমর্মিতা দেখানো যায় ওই কঠিন অপ্রত্যাশিত আঘাতে শোকার্ত বাবা-মাকে!
সবাইকে পাড়ার তরুণ-তরুণীদের দল গঠন করতে বলি। তারা ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করে সপ্তাহে অন্তত দুদিন কোন্ বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী আছে, কজন আছে, তাদের পরীক্ষা করে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থায় সহযোগিতা করবে। পাড়ার কোনো স্থানে, নর্দমায়, খোলা জায়গায় বা বাড়িতে ছাদ বাগানে বা বারান্দার টবে এডিস মশার লার্ভা অনুসন্ধান করে সঙ্গে রাখা কেরোসিন বা ফিনাইল ঢেলে দেবে। খবর দেবে ওয়ার্ডের ফগার মেশিনম্যানকে। আমরা বাল্যকালে মায়েদের নর্দমায় কেরোসিন দিতে দেখতাম। তাছাড়াও ঘরে ঘরে ধূপের ধোঁয়া দেওয়া হতো, যে ধোঁওয়া মশা সহ্য করতে না পেরে ঘর ছেড়ে দূরে চলে যেত। তবে এখন আমাদের মশার জন্মকেই বন্ধ করতে হবে।
খবরে দেখলামÑ দক্ষিণের মেয়র বাড়ি বাড়ি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। আমরা কেউই জানি না যে, শিশু-বয়স্করা স্কুল, অফিস, হাসপাতাল, কর্মস্থল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত মশার কামড় খেয়ে এসেছিল কিনা! আমাদের বিশ^াস, স্কুলে, অফিসে ও হাসপাতালের ওয়ার্ডে পর্দার আড়ালে, বাগানে মশার কামড় খেয়ে বেশির ভাগ রোগী-শিশু-বয়স্ক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে।
২০০০ সালে একবার ডেঙ্গু রোগ দেখা দিয়েছিল, যখন আমি ইউনিসেফ অফিসে কাজ করছিলাম। ওই সময় দেখেছিলাম-অফিসের প্রতিটি ভারি পর্দার আড়ালে মশা লুকিয়ে থাকত। তখন ইউনিসেফের অনেকেরই ডেঙ্গু হয়েছিল, যা এবারের মতো মারাত্মক ছিল না। এবার ডেঙ্গুর নতুন অন্য একটি ধরনের জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে। এটি বড়দের চেয়ে শিশুদের আক্রমণ করছে বেশি। আক্রান্ত নারী-পুরুষের মধ্যে নারীও মারা যাচ্ছে বেশি। এসবের কারণ গবেষণার মাধ্যমে হয়তো জানা যেতে পারে। তেমন গবেষণা হচ্ছে কিনা, জানি না। তবে, রোগ-জীবাণুর ধরন, তাদের প্রভাব ও পরিণতি নিয়ে চিকিৎসা গবেষকরা কাজ করছেন নিশ্চয়।
ডেঙ্গু এখন আমাদের শান্তি দিচ্ছে না। কখন কোন্ শিশুকে নিয়ে যাবে- এ দুশ্চিন্তায় সব অভিভাবকের দিন-রাত কাটছে। চিকিৎসা ব্যয় বেসরকারি হাসপাতালে এত বেশি যে, অনেকে উচ্চ ব্যয়ের জন্য হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। যা কাক্সিক্ষত নয়। অনেক শিশুই দ্বিতীয় অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছে। বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয় ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ৫০% হ্রাস করা প্রয়োজন। তারা সবসময় ব্যবসা না করে কোনো সংকট সময়ে জাতিকে সেবাও দেবে- এ আশা করতেই পারে মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন দেশের জনসাধারণ।
অধিকাংশ সম্ভবত শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের বিল্ডিংয়ের দুজন ডাক্তার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন সেরে উঠেছেন। অথচ এ বিল্ডিংয়ের কোনো ফ্ল্যাটে মশা নেই। তার মানে-কর্মস্থল, হাসপাতালে ডেঙ্গু মশার কামড় খেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন দুজন। তাই স্কুল, কলেজ, অফিস-আদালত, হাসপাতালে ডেঙ্গু মশা মারার ব্যবস্থা অনেক বেশি জোরদার করতে হবে। এটা তো জানা কথাÑ শিশুদের বাঁচাতে মা-বাবা নিজেরা বাসাবাড়ি পরিচ্ছন্ন, মশামুক্ত রাখতে সবসময় সচেষ্ট থাকেন। সুতরাং পাড়া-মহল্লার পাশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব কর্মস্থলকে মশামুক্ত করতে কর্তৃপক্ষকে আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গুর কাছে আমাদের শিশুদের বা বড়দের জীবন তুলে দিতে পারি না কিছুতেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ