ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে কবে মুক্তি মিলবে শিশুদের
শিশু চিকিৎসক হিসেবে জীবনের এ প্রান্তে এসে পরিবারিক শিশু নির্যাতন বন্ধে চারটি কথা বলবো-
১. শিশুকে জোর করে খাওয়াবেন না।
২. শিশুর সামনে সহিংসতা করবেন না, ঝগড়া বা জোরে কথা বলবেন না।
৩. শিশুকে মিথ্যা বলবেন না, শিশুর সামনে মিথ্যা বলবেন না।
৪. শিশুকে ভয় দেখাবেন না!
সারা বিশ্বে, তৃতীয় বিশ্বে, বাংলাদেশে শিশুদের অনেক ব্যথা। সংসারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, যুদ্ধ, অমানবিক আচরণ, ক্ষুধা, অনাদরে তারা মুহ্যমান। তাদের অনেকের বাবা বিদেশে চাকরি করে দেশে টাকা পাঠায়। আমরা ফুটানি করি। এ সব রেমিটেন্স বীরেরা দেশে আসলে সম্মানের পরিবর্তে হয়রানি ও অপমানের শিকার হন। বড় লজ্জা! তাদের সন্তানেরা পিতৃআদর বঞ্চিত। এ সব শিশুরাও বীর।
শিশুরা বড়দের আচরণের অহেতুক ভুক্তভোগী। তারা উচ্চ রবে কাঁদে, মনে মনে কাঁদে। তাদের কান্না খোদার দরবারে ঝুলে আছে!
উপরের চারটি কথা, পারিবারিক শিশু নির্যাতনের সংজ্ঞায় পড়ে। উন্নত বিশ্বে শিশুকে জোর করে খাওয়ালে, ধমক দিলে, তাদের সামনে সহিংসতা করলে, ঝগড়া বিবাদ করলে, নির্যাতন করলে দস্তুর মতো পুলিশ আসে!
রাষ্ট্র তাদের নিয়ে যায়, যদি তারা পরিবারে বড় সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হয়, পরিবারের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা রজু হয়।
শিশু খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে কেনো! যে কোন যুক্তিতে তার উত্তর হলো, তার খেতে ভাল লাগছে না। আপনি আর আমি বলবো, কী বলেন, তার পেটে ক্ষুধা! সে সাত দিনের মধ্যে কিছু খায় নি, দেখছেন না সে কতো রোগা! তার বয়সের একটা বাচ্চার কি শরীর এ রকম কাঠি কাঠি থাকে! সাথে উদাহরণও দিলেন! অমুকের বাচ্চা কেমন গপাগপ খায়! এ রকম কথা শিশুটির সামনে, তাকে শুনিয়ে বলাটা, আমার মতে, যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তবে বলতাম, ফৌজদারী অপরাধ (কথার কথা), কেননা আপনি জানেন কি, এতে তার মগজের কতোখানি ক্ষতি করলেন? যা কোনদিন পূরণ হবে না! অথচ আপনি শিশুর এত বড় ক্ষতি করেও তার মা! আশ্চর্য! অনেক পিতা শিশুর উপর মায়ের দৈনিক এ নির্যাতনে কতো কষ্ট পায়! নিরবে কাঁদে। কিন্তু কিছু বললেই মা হয়ে যান অগ্নিশর্মা- ‘ তুমি পেটে ধরোনি তো! কি বুঝবে, তোমার কারণেই এমন হয়েছে। আহারে বাচ্চাটা আমার কি হয়ে গেলো।’ সত্যিই আপনি বড় ক্ষতিকর। তা না হলে, উন্নত বিশ্বে, এমন আবস্থায় মা থেকে কি খামাখা শিশুকে আলাদা করে নেয়া হয়!
যুক্তি কি বলে? একটা শিশুর ক্ষুধা পেয়েছে, তাকে খাবার দেয়া হচ্ছে, অথচ খাচ্ছে না, এ জগতে এমন হতে পারে! আপনি অসুস্থ মা। আপনি মানসিকভাবে ভুগছেন।
বলবেন, তবে খায় না কেনো? হ্যাঁ। এতক্ষণে বলেছেন কথা একটা। আরো বলতে পারেন, অমুকের বাচ্চা কি সুন্দর দিলেই খায়, কেনো?
এ রহস্য বুঝার জন্য, এ বিজ্ঞান বুঝার জন্য, স্বতন্ত্র একটা লেখা লিখতে হবে। লিখবো ইনশাল্লাহ। তবে তার আগে আজই জোর করে খাওয়ানো বন্ধ করুন। কেনোনা, আপনার সাথে শিশুটির সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। এমনিতে সে খেলা করে, দৌড়ায়, হাসে, মজা করে! কিন্তুু খাবারের কথা এলেই তার মন কেমন হয়ে যায়। এটা এমন হচ্ছে যে, যেনো একটা মানুষকে দৈনিক তিন চার বেলা চাবুক মারা হচ্ছে। আপাতত হাসিমুখে তার সাথে খাবার নিয়ে বসুন। যেখানেই সে খাবে না বলছে, সেখানেই হাসিমুখে তা রেখে দিন। সপ্তাহ খানেক বা দিন পনেরো এমন করে দেখুন।
আমাদের দেশে সংসদে, সমাজে, ঘরে, নগরে, বন্দরে, শহরে, শিশু প্রায় অনুল্লেখ্য একটা আদরের পুটলি মাত্র। বড় মনে করেন, শিশু বুঝেনা। তাকে খেলতে দিলেই হলো। আগে খাইয়ে ঘুম পাড়ালেই দায়িত্ব শেষ।
কিন্তুু না। শিশুরা সবচে বড় শিল্পী, সবচে বড় বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানীতো বটেই, তারা সবচে বড় দার্শনিক। তারা বড়দের ছোট সংস্করণ নয়। তারা স্বতন্ত্র সম্মানিত পরিপূর্ণ।
যে দেশে যত লাইব্রেরী, যে দেশে শিশু যত গুরুত্ব পায়, সে দেশ তত উন্নত। এটাই অধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দেশের উন্নয়ণের সূচক। শিক্ষা নিয়ে শিশুদের গিনিপিগ বানানো, বড় নির্মম ও হতাশাজনক এবং অন্যায়। এটাও শিশু নির্যাতন। শিশুদের জন্য বরাদ্ধ, শিশুদের নিয়ে সংসদে মর্যাদাজনক আলোচনা, পরিকল্পনা ও ভাবনা জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান নিয়ামক। শিশু রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি করে না, অথচ ক্ষতির নির্মম শিকার।
আমাদের দেশে আমরা শিশুদের আদর করতে কম করি না। তবে শিক্ষিত সমাজে, বিশেষ করে অনেক শিক্ষিত মায়ের কাছেই শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। শুনতে অবাক লাগবে, মায়ের এ ধরনের অত্যাচার থেকে শিশুকে বাঁচাতে কোনো এক উন্নত দেশে নাকি শিশুদের অপারেশন করে দেয়া হয়, যাতে নল দিয়ে মা শিশুকে সরাসরি পেটে খাওয়াতে পারেন। যদিও এটি চরম ব্যতিক্রম। তবুও এ আচরণের ভয়াবহতা অনুধাবনের জন্য এ উদাহরণ টানলাম।
শিশুর জন্য মাতৃজঠর থেকে শুরু করে প্রথম দুই বছর, কিছুটা হলেও ছয় বছর পর্যন্ত সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়েই তার মস্তিষ্কের কোষ পরিপুষ্ট হয়। এ সময়ের বিরূপ আচরণের প্রভাব সারা জীবন সে ভোগ করে।
আজ যে শিশু, সমাজের সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়েছে, মাদকাশক্তি তার সকল শক্তি কেড়ে নিয়েছে, মা বাবার কথা সে শুনছে না, কু আচরণ করছে, নিজেরা সহিংসতা করছে, বেয়াদবি করছে, জঙ্গী হচ্ছে, পিটিয়ে সহপাঠিকে মেরে ফেলছে, এর প্রায় সবটাই ঐ দুই বছরে তার সঙ্গে আচরিত ঘটনার ফল!
শিশু আনন্দ চায়, দুঃখ চায় না, পরিবারে মেলবন্ধন চায়, ঝগড়া একদম পছন্দ করে না। মিথ্যা সে সহ্য করতে পারেনা। শিশুরা শুদ্ধ মানুষ। আমরা বাজে মানুষ।
অন্তত, পারিবারে, বুঝে না বুঝে, নিরবে সরবে, ক্রমাগতভাবে চালিত শিশু নির্যাতন বন্ধ হোক।
আজকের শিশুই কালকের যুবা। তারা দেশ চালাবে। তারা যেনো সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠন করে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
[লেখকঃ শিশু বিশেষজ্ঞ ও শিশু সংগঠক;
সাবেক সভাপতি, বিএমএ, কুমিল্লা]