ঘরবন্দি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব

‘আগে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। সবাই মিলে খেলাধুলা করতাম। করোনার কারণে অনেক দিন স্কুলে যাই না। ওদের (বন্ধুদের) সঙ্গে দেখা হয় না। সারা দিন বাসায় থাকি। বাসায় নিজে নিজে খেলি, গান শুনি, ভিডিও দেখে নাচ শিখি।’ কথাগুলো বলছিল রাজধানীর মিরপুরের কিংশুক পার্টিসিপেটরি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থী তোরসা তাবাসসুম।

আবার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আদিব আলম শুদ্ধ বলে, ‘আমি আগে রাস্তায়, মাঠে সাইকেল চালাতাম। করোনার কারণে এখন বাইরে যেতে পারি না। গ্যারেজে সাইকেল চালাই। ছোট বোনকে নিয়ে আগে মাঠে খেলা করতে যেতাম, এখন আর মাঠে যাই না। বাসায় থাকতে আর ভালো লাগছে না। বন্ধুদেরও অনেক মনে পড়ে। ওদেরও কত দিন হলো দেখি না!’

শ্যামলীর প্রিমরোজ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কেজির শিক্ষার্থী আকিদ হায়দারের মা রহিমা আক্তার রুমা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছেলেটা আগে প্রতিদিন স্কুলে যেত, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাত। বাসায় ফিরেও খেলাধুলা করত। করোনা মহামারির এই দীর্ঘ সময় স্কুল না থাকায় এখন সারা দিন মোবাইল আর কম্পিউটারে গেম নিয়ে থাকে। সময়মতো গোসল করতে চায় না, খেতে চায় না। লেখাপড়া নিয়ে হেলামি করে। রাগ-অভিমান করে। এরই মধ্যে জ্বর, মাথা ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছেও যেতে হয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শে এখন ওকে মোবাইল ও কম্পিউটার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছি।’

করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে এভাবে ঘরবন্দি জীবন যাপন করছে শিশুরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এক রকম বাসায়ই থাকতে হচ্ছে তাদের। করোনা থেকে রক্ষা পেতে মাঠে খেলতে যাওয়াও বন্ধ। বাইরে খোলা পরিবেশে যাওয়ার সব পথ বন্ধ হওয়ায় চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে শিশুদের জীবন। আবার করোনাকালে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পারিবারিক সহিংসতা বাড়ায় সেসবের নেতিবাচক প্রভাবও পড়ছে শিশুদের ওপর। সব কিছু মিলিয়ে শিশুদের ওপর নেমে এসেছে এক ভয়াবহ মানসিক চাপ।

শিশু-কিশোরদের ওপর করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৩টি উন্নয়নশীল দেশে জরিপ চালিয়েছে উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন। ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কভিড-১৯’ শিরোনামের এই জরিপে বলা হয়, ৯১ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত, সামাজিক দূরত্ব আর পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ায় মানসিক চাপ এবং হতাশায় ভুগছে শিশুরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ৭১ শতাংশ শিশু-কিশোর নিজেদের বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ ভাবছে। বাংলাদেশ, আলবেনিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, ব্রাজিল, কঙ্গো, মালি, মঙ্গোলিয়া, নিকারাগুয়া, পেরু, ফিলিপাইন, রোমানিয়া, সিয়েরা লিওন ও তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের ওপর এ জরিপ চালানো হয়। ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সের ১০১ জন শিশু (৫৮ জন মেয়ে, ৪৩ জন ছেলে) এই জরিপে অংশ নেয়। জরিপে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা হারিয়ে শিশু-কিশোররা অসমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লকডাউনে অনেক শিশু প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় লেখাপড়া করতে পারছে না।

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরবন্দি অবস্থা শিশুদের মধ্যে মানসিক অবসাদ তৈরি করে। এটি তাদের মনোজগতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ভয় যেন শিশুর মনকে ঘিরে ধরতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। শিশুরা যাতে মানসিক চাপমুক্ত পরিবেশ পায় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। স্বাভাবিক সময়ে ব্যস্ততার কারণে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পান না অনেক অভিভাবক। এখন করোনা পরিস্থিতিতে শিশুদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দময় করে তোলার প্রয়াস নিতে হবে।

সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাইকো সোশ্যাল সাপোর্ট বিশেষজ্ঞ রুমা খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনায় শিশুরা খুব বাজে পরিস্থিতিতে পড়েছে। শিশুদের পাশাপাশি বড়রাও এখন বাসায় থাকায় নতুন নতুন পন্থায় শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করতে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে। শিশুদের মানসিক বিকাশে স্কুল খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, বন্ধু ও শিক্ষকদের সহায়তা নিতে শেখা, অন্যদের সহায়তা করার পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হয়। করোনায় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা মোবাইল, কম্পিউটার, ভিডিও গেমিংয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মানসিক বিকাশে যে ব্যবহারিক ও মনস্তাত্ত্বিক চর্চাগুলো দরকার সেগুলো তারা পাচ্ছে না। প্রযুক্তির প্রতি শিশুদের এই আসক্তির ক্ষতিকর দিকটা এখন খুব বেশি বোঝা যাচ্ছে না। তবে তারা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে তখন বিষয়গুলো ফুটে উঠবে। করোনার আফটার ইফেক্ট হিসেবে সেটি থেকে যাবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924