ঘরবন্দি শিশুদের স্থূলতা বাড়ছে

করোনা ভাইরাসের কারণে বদলে যাওয়া জীবনযাপনে নানা সমস্যা ও সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে শিশু স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও বেড়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুরা দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দি। শারীরিক কর্মকা- কমে যাওয়া, অপরিমিত খাদ্য গ্রহণ এবং ডিজিটাল ডিভাইসে মগ্ন থাকায় এ সময়ে বাড়ছে শিশুদের স্থূলতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা।

শিশুদের স্থূলতা প্রসঙ্গে চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান পুষ্টিবিদ মাজহারুল হক চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, শিশুর ওজন কত হওয়া উচিত, সেটা তার বয়স ও উচ্চতার ওপর নির্ভর করে। শৈশবে মুটিয়ে যাওয়ার নানা কারণ আছে। বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনযাপনের সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ সময়ে শিশুরা যত ক্যালরি গ্রহণ করে, তা পোড়ায় না। ফলে নিয়মিত তা তার শরীরে জমতে থাকে। শিশুরা স্কুলে গেলে তাদের একটা ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি হতো, এখন সেটাও নেই। তারা এখন বাসায় টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপে সময় বেশি দিচ্ছে। আবার খাবার গ্রহণেও নেই কোনো সতর্কতা।

মুটিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে কিছু জিনগত কারণও আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বে স্থূলতা বা মুটিয়ে যাওয়াকে একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে অনেকগুলো ক্রনিক ডিজিজ বা ব্যাধির অন্যতম রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকির মধ্যে স্থূলতা একটি। বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও স্থূলতায় আক্রান্ত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ছোটবেলায় শিশুরা মোটা হয়ে গেলে তাদের প্রায় ৭০ শতাংশই সেই স্থূলত্ব বয়স্ক অবস্থা পর্যন্ত ধরে রাখে।

রাজধানীর পশ্চিম হাজীপাড়ার আট বছর বয়সী ফাইজার ওজন ৪৫ কেজি। তৃতীয় শ্রেণির এই শিশুর ওজন নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। চিকিৎসকের পরামর্শ, তাকে ভাত খাওয়া বন্ধ করতে হবে। প্রক্রিয়াজাত চালের ভাতের পরিবর্তে ওটস খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। অতিরিক্ত চিনি, তেল, চর্বি, ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় খাওয়া যাবে না।

মগবাজারের একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাশকায়েতের ওজন ৬৮ কেজি। ৪ ফুট ৫ ইঞ্চি মাশকায়েতের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন অন্তত ১০ কেজি বেশি। তার মা জানান, হঠাৎ ছেলের ওজন অনেক বেড়ে গেল। স্কুল খোলার সময় প্রতিদিন ক্রিকেট খেলত। এখন বাড়িতে এক/আধ ঘণ্টা পড়ার টেবিল ছাড়া খাওয়া, টিভি দেখা আর ঘুমেই সময় কাটে। ছেলে মুটিয়ে যাওয়ায় তারা চিন্তিত। শিগগির ডাক্তার দেখাবেন।

এ বিষয়ে পুষ্টিবিদ মাজহারুল হক বলেন, অনেক বাবা-মা আদর করে সন্তানদের ফাস্টফুড খাওয়ান, এতে তার মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সেটা অভিভাবকরা খেয়াল করেন না। শিশুদের স্থূলতা যে একটি স্বাস্থ্য সমস্যা, সেটি নিয়ে আমাদের দেশে ধারণা খুবই কম। শিশু মোটা হয়েছে বলে খুশি হবেন না। তার ওজন সঠিক মাত্রায় আছে কিনা, জেনে নিন। ওজন অতিরিক্ত হলে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

স্থূলতা এড়াতে এই পুষ্টিবিদের পরামর্শ, ঘরে ব্যায়াম করার অভ্যাস করতে হবে। অনেক ধরনের ব্যয়াম আছে যেগুলো ঘরে চর্চা করা যায়। অবশ্যই শিশুকে খেলাধুলা ও শারীরিক পরিশ্রমে উৎসাহ দিতে হবে। বসে বসে কম্পিউটার ব্যবহার বা গেমস খেলতে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বেশি বেশি ফলমূল ও শাকসবজি খেতে শিশুকে উৎসাহ দিন। শিশুকে যখন-তখন চিপস, জুস, চকোলেট কিনে দেবেন না। উপহার বা পুরস্কার হিসেবে শিশুর হাতে ফাস্টফুড বা চকোলেট নয়। শিশুকে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় ও চর্বিযুক্ত খাবার দেবেন না। তেলযুক্ত বা মিষ্টি খাবার নয় বরং ঘরে রান্না করা স্বাস্থ্যকর খাবার বা ফলমূল দিন। টেলিভিশন, কম্পিউটার বা স্মার্টফোন দেখিয়ে খাওয়াবেন না। এ ছাড়া জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুকে শুধু মায়ের বুকের দুধ দিতে হবে।

শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী বলেন, দেশে স্থূলতার কী অবস্থা সে সম্পর্কে তেমন গবেষণা হয়নি। স্থূলতা এমন একটি স্বাস্থ্যগত ব্যাপার যেটি নিয়ে আমাদের নানা ধরনের অভিমত রয়েছে। অনেকে মনে করেন স্থূলতা শুধু খাদ্যাভ্যাসের কারণেই হয়। অর্থাৎ বেশি খেলেই মানুষ মুটিয়ে যায়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে খাদ্যাভ্যাস স্থূলতার একটি কারণ হলেও এটিই একমাত্র কারণ নয়।

তিনি বলেন, ধারণা করা হয় স্থূলতার কারণ মনোজাগতিক, পারিপার্শ্বিক, সামাজিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে অর্থনৈতিক। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশে স্থূলতা বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের পুষ্টিহীনতা দিন দিন কমছে; অন্যদিকে স্থূলতা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে এটি বাংলাদেশের জন্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার অন্যতম একটি হতে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *