করোনা শেষে এক নতুন পৃথিবী (পর্ব–৩)
জনগণকে প্রাইভেসি এবং স্বাস্থ্যের মধ্যে যেকোন একটি বেছে নিতে হবে, বলাটাই সবচেয়ে বড় ভুল। কেননা আমরা একই সাথে স্বাস্থ্য এবং প্রাইভেসি উপভোগ করতে পারি। এবং এমনটাই হওয়া উচিত। আমরা আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারি আবার করোনাভাইরাস মহামারীও ঠেকাতে পারি। এর জন্য সার্বক্ষণিক কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে থাকার প্রয়োজন নেই। নাগরিকদের ক্ষমতায়নই এর জন্য যথেষ্ট।
নাগরিকরা নির্দেশনা মেনে চলবে, এটা নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্র থেকে তদারকি আর কঠিন শাস্তি প্রদান একমাত্র উপায় নয়। যখন নাগরিকদের সামনে বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো তুলে ধরা হবে এবং যখন তারা তথ্যগুলোর ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উপর আস্থা রাখতে পারবে তখন উপরওয়ালাদের নজরদারি ছাড়াই নাগরিকরা সঠিক কাজটা করবে। পুলিশি নজরদারিতে থাকা মুর্খ জনগণের চেয়ে স্বপ্রণোদিত ও সচেতন জনগণ অনেক বেশি শক্তিশালী , অনেক বেশি কাজের।
সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যাপারটাই ধরেন না। মানবজাতির পরিচ্ছন্নতার ইতিহাসে এটি অনেক বড় একটি মাইলফলক। এই ছোট্ট একটি কাজ প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ জীবন বাঁচায়। আমরা হয়ত বিষয়টি গোনায় ধরছি না।
অথচ উনিশ শতকের আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার গুরুত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা ছিলো। এমনকি ডাক্তার নার্সরাও হাত না ধুয়েই একটার পর একটা সার্জিকাল অপারেশন করেছেন সেই সময়ে। এখন প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ হাত ধুচ্ছেন।
তারা কোন সাবান পুলিশের ভয়ে ভীত হয়ে এই কাজ করছেন না। বরং তাদের জানা সঠিক তথ্যগুলো তাদেরকে হাত ধুতে উৎসাহিত করছে। আমি সাবান দিয়ে হাত ধুই, কারণ আমি ভাইরাস – ব্যাকটেরিয়ার কথা শুনেছি।
আমি জানি যে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু অনেক রোগ ব্যাধির কারণ। আর আমি এটাও জানি যে সাবান এগুলোকে মেরে ফেলতে পারে।
তবে এই স্তরের সচেতনতা ও সে অনুযায়ী কাজের জন্য আস্থার দরকার। বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা, সরকারের প্রতি আস্থা ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতি আস্থা।
বিগত কয়েক বছর ধরে কিছু কান্ডজ্ঞানহীন রাজনীতিবিদের ইচ্ছাকৃত কার্যকলাপের কারণে জনগণ বিজ্ঞানের ওপর, সরকারের ওপর ও সংবাদ মাধ্যমের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে। এখন সেই একই রাজনীতিবিদ কর্তৃ্ত্ববাদের মহাসড়কে উঠতে অতি আগ্রহী হতে পারে। তাদের যুক্তি থাকবে, সঠিক কাজ করার ব্যাপারে জনগণের ওপর আস্থা রাখা যাবে না।
স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে, যে বিশ্বাস বছরের পর বছর ধরে অল্প অল্প করে ভেঙ্গেছে তা রাতারাতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না। কিন্তু এখন স্বাভাবিক সময় নয়। সংকটকালে মানুষের মনও খুব দ্রুত বদলায়। আপনার ভাইবোনদের সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের তিক্ত সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু জরুরি প্রয়োজনের সময় দেখবেন তার জন্য আপনার মনের গহীনে ঠিকই এক মায়ার জায়গা রয়ে গেছে।
তখন একজন আরেকজনকে সাহায্য করতে ছুটে যাবেন। একটি নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে বিজ্ঞান, সরকার ও সংবাদমাধ্যমের উপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে এখনো খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি।
আমাদের অবশ্যই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত, কিন্তু সেটা নাগরিকদের ক্ষমতায়িত করার জন্য। আমি অবশ্যই আমার তাপমাত্রা, রক্তচাপ পর্যবেক্ষণের পক্ষে, কিন্তু সেটা কোন মহাপরাক্রমশালী সরকার তৈরি করুক তা আমি চাই না। বরং সেই তথ্যগুলোর কাজ হবে ব্যক্তিগত বাছ বিচারের ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করা এবং সরকারকেও তার সিদ্ধান্তগুলোর জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করা।
আমি যদি আমার শারীরিক অবস্থা দিনরাত ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণ করতে পারি, তাহলে আমি অন্যের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি কিনা তা জানতে পারবো। একই সাথে কোন অভ্যাসগুলো আমার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো তাও জানতে পারবো।
আর যদি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ওপর নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানে আমার প্রবেশাধিকার থাকে, আমি যদি সেগুলো বিশ্লেষণ করতে পারি, তাহলে সরকার আমাকে এ ব্যাপারে সত্য বলছে কিনা কিংবা মহামারী ঠেকাতে সঠিক নীতি অনুসরণ করছে কিনা তা আমি যাচাই করতে পারবো।
মনে রাখবেন, নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকার শুধু জনগণকে পর্যবেক্ষণে রাখতে পারে তা কিন্তু নয়, একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণও সরকারকে পর্যবেক্ষণে রাখতে পারে।
তাই করোনাভাইরাস মহামারী নাগরিকত্বের জন্যে এক অগ্নি পরীক্ষা। সামনের দিনগুলোতে আমাদের প্রত্যেককে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞের উপর আস্থা রাখতে হবে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা কোন স্বার্থপর রাজনীতিবিদের উপর নয়।
আমরা যদি সঠিকটা বেছে নিতে ব্যর্থ হই, তাহলে দেখা যাবে আমরা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান স্বাধীনতাটুকু ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি এই ভেবে যে, এটাই আমার স্বাস্থ সুরক্ষার একমাত্র উপায়।
(চলবে)
মূল: ইউভাল নোয়াহ হারারি
অনুবাদ: ডা. নাজিরুম মুবিন
চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা