করোনাকালে শিশু-কিশোরদের মনের বিশেষ যত্ন প্রয়োজন

করোনাভাইরাসের এ অতিমারির সময়ে সবারই মনের ওপর চাপ বাড়ছে। সবার মতো শিশু-কিশোররাও মানসিক চাপে রয়েছে। তাদের স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ, পড়ালেখা-পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা, সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে না, নেই বাইরে গিয়ে খেলাধুলার সুযোগ। আবার তাদের মনেও আছে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয় ও মৃত্যুভীতি। অনলাইন ক্লাস আর নতুন নতুন নিয়মকানুনের সঙ্গে মানিয়ে চলাও কঠিন মনে হতে পারে। এ সময়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে যেসব মানসিক লক্ষণ বেশি দেখা দিতে পারে তা হলো-

ঘুমের রুটিন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। সারারাত জেগে থাকা আর সারাদিন ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে। এ ঘুমের সমস্যা শিশুর আবেগ আর আচরণকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। শিশুর মধ্যে হঠাৎ রেগে যাওয়া বা খিটখিটে মেজাজের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময় কাছের মানুষের সঙ্গে (পরিবারের সদস্য) দূরত্ব তৈরি হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বা ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটে আসক্তি বেড়ে যেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাদকাসক্তিও দেখা যায়।

একদম যারা ছোট শিশু তারা মা-বাবাকে বেশি করে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। কেউ বা নিজেকে গুটিয়ে রাখে। কেউ বেশি কান্নাকাটি করে, সারাক্ষণ একই কথা বলতে থাকে। কেউ বা বিছানায় প্রস্রাব করা শুরু করে। বুক ধড়ফড় করা, ফুসফুসের সব ঠিক থাকা সত্ত্বেও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি, ঘাম হওয়া, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসা, শরীরে শক্তি না পাওয়া ইত্যাদি সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

২. আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা

আবেগের বহিঃপ্রকাশ খুব বেশি হতে পারে, আবার কারও কারও আবেগ কমে যেতে পারে। কেউ বেশি বেশি কান্নাকাটি করে, মন খারাপ করে থাকে। কোনো কিছুতেই উৎসাহ পায় না।

৩. চিন্তা ও মনোযোগের সমস্যা

কোনো কাজে মন বসে না : কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না। এমনকি পছন্দের বিষয়টিতেও। সাধারণ বিষয়গুলোও ভুলে যেতে থাকে। দৈনন্দিন বিষয়গুলো মনে রাখতে পারে না। কাজ জমিয়ে রাখে। শিশুদের মধ্যে তীব্র মানসিক চাপ (স্ট্রেস), বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন), উদ্বিগ্নতা (অ্যাংজাইটি), ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি মানসিক সমস্যা বেশি দেখা যেতে পারে।

করোনাকালীন বড়দের মতো শিশুদেরও মনের যত্নের প্রয়োজন। এ সময় শিশু-কিশোরদের মনের যত্নের জন্য যা যা করা যেতে পারে-

গুণগত সময় : বাবা-মায়েরা এ সময় শিশুদের গুণগত সময় দেবেন। প্রত্যেক শিশুকে আলাদা করে সময় দেবেন। তাদের সঙ্গে গল্প করবেন, খেলবেন, মনের ভাবটিকে বোঝার চেষ্টা করবেন। শিশুরাও এ সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটাবে। একা একা থাকবে না। মা-বাবারা সন্তানের ওপর বিরক্ত হবেন না। তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তাদের মিথ্যা বলবেন না। তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্যারম, লুডু বা অন্য কোনো ঘরোয়া খেলায় অংশ নিতে পারেন। সন্তানের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে দেরি করবেন না

অস্থিরতা নয় : বাবা-মায়েরা অস্থিরতা সৃষ্টি করবেন না। হায় হায় আমার সন্তান পিছিয়ে যাচ্ছে বলে হা-হুতাশ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, এখন একটি অতিমারি চলছে। এ সময় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় কাজ।

রুটিন ঠিক রাখতে হবে : বিশেষ করে ঘুমের রুটিন। রাতে ঘুমাতে হবে আর দিনে অ্যাক্টিভ থাকতে হবে। সময়মতো গোসল আর খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। ঘুমের কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগেই মুঠোফোন, ল্যাপটপ বা টিভি দেখা বন্ধ করতে হবে।

গুজবে কান দেওয়া যাবে না : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা সবকিছুতে বিশ্বাস রাখা যাবে না। কেবল নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য গ্রহণ করতে হবে।

দৈনন্দিন কাজে অংশ নেওয়া : পড়ালেখা করা, নিজের যত্ন নেওয়া, বই পড়া, মুভি দেখা বা নিজের ব্যক্তিগত কাজগুলো বজায় রাখতে হবে। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মচর্চা করাও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে।

পাল্টাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি : ঘরে থাকাকে বন্দিত্ব মনে করা যাবে না। কেউ ঘরবন্দি নয়। বাইরের পৃথিবীটাই বন্দি। ঘরেই সবাই মুক্ত। ভাইরাস থেকে মুক্ত। সংক্রমণ থেকে মুক্ত।

ঘরের কাজে অংশ নিতে হবে : পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে মিলে ঘরের ছোটখাটো কাজ, যেমন রান্নায় সাহায্য করা, ঘর পরিষ্কার করা ইত্যাদিতে অংশ নিতে হবে।

সামাজিকভাবে যুক্ত থাকা : এ সময় বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে না। কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু তাই বলে ইন্টারনেটে আসক্ত হওয়া চলবে না। ইন্টারনেটের যৌক্তিক ব্যবহার করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, করোনা-পরবর্তী নতুন জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে শিশুরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। তাই এখন থেকেই নতুন জীবনধারা রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে শিশুদের। পুরো পৃথিবীর এ দুঃসময়ে আরও বেশি মানবিক গুণাবলীর চর্চা করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর বিজ্ঞানকে শিশুরা যাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে শেখে সেটার চর্চা করতে হবে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ : মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; সহযোগী অধ্যাপক, চাইল্ড এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924