আপনি কি বাংলাদেশে শিশু দত্তক নিতে পারবেন?
বাংলাদেশে নিঃসন্তান দম্পতিদের একমাত্র বিকল্প হলো ১৮৯০ সালের অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনের অধীনে বৈধ অভিভাবকত্বের জন্য পারিবারিক আদালতে আবেদন করা। আইন অনুযায়ী শিশুর বয়স ১৮ বছরের কম হতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, অভিভাবকত্বের অধীনে থাকা শিশুরা সমস্ত অধিকার ভোগ করে না, যেমন বৈধ অভিভাবকের কাছ থেকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় না। এভাবে তারা দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে। তাদের সম্পত্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো আইনি অভিভাবক যদি মৃত্যুর আগে কোনও সম্পত্তি ‘উপহার’ হিসেবে সন্তানকে দান করে যায়।
১৩ বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হন জনাব ওদুদ ও তার স্ত্রী। অনেক ডাক্তার, কবিরাজ, হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন। তার স্ত্রী বলেন, পানিপড়া, ওষুধ, আয়ুর্বেদিক ওষুধ, স্ত্রী লিলি ফুল— আমি সবার পরামর্শে সবই খেয়েছি, কিছুই কাজ করেনি।
১৩ বছর পর ওদুদ দম্পতি গ্রামের বাড়ি থেকে একটি শিশুকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা একটি দরিদ্র গর্ভবতী দম্পতিকে খুঁজে পান এবং তাদের সাথে চুক্তি করেন যে, জন্মের ছয় মাস পর তারা শিশুটিকে দত্তক নেবেন। এজন্য তারা অর্থ দেওয়ার বিষয়টিও চূড়ান্ত করেন। একটি স্ট্যাম্প পেপারে সেই দরিদ্র পরিবারের টিপসই নেওয়া হয়, যেখানে লেখা ছিল ‘আমরা আমাদের সন্তানকে জনাব ওদুদ ও তার স্ত্রীকে দিচ্ছি। এখন থেকে এই শিশুটির ওপর আমাদের কোনও অধিকার নেই।’
এভাবেই ২০০৪ সালে জেরিন তার নতুন বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় আসেন।
তবে ব্যারিস্টার মো. হাফিজুর রহমান খান বলেন, স্ট্যাম্প পেপারে স্বাক্ষর করা অনাপত্তিপত্র বাংলাদেশে শিশু দত্তক নেওয়ার আইনগত উপায় নয়।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ও ১৯৩৭ সালের মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরীয়াহ) অনুযায়ী, এতিম বা অসহায় শিশুকে লালন-পালন করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে সন্তানের পিতামাতার নামের স্থলে পালক দম্পতির নাম কখনো ব্যবহার করা যাবে না। কারণ ইসলাম তার বৈধতা দেয় না।
ব্যারিস্টার হাফিজুর বলেন, ‘বাংলাদেশে নিঃসন্তান দম্পতিদের একমাত্র বিকল্প হলো ১৮৯০ সালের অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনের অধীনে বৈধ অভিভাবকত্বের জন্য পারিবারিক আদালতে আবেদন করা।’
আইন অনুযায়ী শিশুর বয়স ১৮ বছরের কম হতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, অভিভাবকত্বের অধীনে থাকা শিশুরা সমস্ত অধিকার ভোগ করে না, যেমন বৈধ অভিভাবকের কাছ থেকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় না। এভাবে তারা দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে। তাদের সম্পত্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো আইনি অভিভাবক যদি মৃত্যুর আগে কোনও সম্পত্তি ‘উপহার’ হিসেবে সন্তানকে দান করে যায়।
জেরিনের ক্ষেত্রে, তাকে ঘরে আনার পর জন্মসনদে বাবা-মায়ের নাম হিসেবে জনাব ওদুদ ও তার স্ত্রীর নাম বসানো হয়। যা তাদেরকে জেরিনের আইনি বাবা-মা বানিয়ে দেয়।
ব্যারিস্টার হাফিজুর বলেন, প্রক্রিয়াটি এভাবেই কাজ করে। এখনো অনেক ক্ষেত্রে খুব অনানুষ্ঠানিক। অনেক সময় তা ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে। জন্মদাতা দম্পতি যে কোনও সময় এসে নিজেদের সন্তানের দাবি করে বসতে পারেন। আর সন্তান যেতে চাইলে সে যেতে পারবে।
এদিকে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (সংশোধিত) অনুযায়ী একটি শিশুকে দত্তক নিতে পারে। তবে শুধু ছেলে শিশুকে দত্তক নেওয়া যাবে। পালক দম্পতিকে সমগোত্রের হতে হবে। আর অবশ্যই দত্তক নেওয়া ব্যক্তি হতে হবে একজন পুরুষ। পরিবার অনুমতি দিলেই কেবল স্ত্রী কোনও শিশুকে দত্তক নিতে পারবেন।
ব্যারিস্টার হাফিজ বলেন, ‘শাস্ত্রীয় হিন্দু আইন দত্তক গ্রহণকে ধর্মনিরপেক্ষ আইনের চেয়ে একটি ধর্মীয় বিধি হিসেবে বেশি দেখেছে। দত্তক গ্রহণের উদ্দেশ্য হলো দুটি: একজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা এবং একজনের বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।’
দত্তক নেওয়া শিশুকে নিয়ে বিদেশ গমন
বৈধ অভিভাবকত্বের প্রক্রিয়া হলো প্রথমে অভিভাবকত্ব নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি জন্মদাতা কিংবা শিশু যে এতিমখানায় আছে তাদের অনুমতি সাপেক্ষে দেওয়ানি কার্যবিধি আইন অনুযায়ী পারিবারিক আদালতে একটি আবেদন করবেন।
আবেদনটি পর্যালোচনা করার পর আদালত যদি সন্তুষ্ট হন যে পিতামাতারা সেই সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য, তাহলে বৈধ অভিভাবকত্বের অনুমোদন দেওয়া হবে। আর আদালত বিরুদ্ধে রায় দিলে জেলা জজ আদালতে আপিল করা যাবে।
অনুমোদন দেওয়া হলে উভয় পক্ষ আদালতে উপস্থিত হবে এবং প্রকৃত পিতামাতাকে বিচারকের সামনে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তারা অভিভাবকত্বের জন্য স্বেচ্ছায় সন্তানকে অন্য পক্ষের কাছে তুলে দিচ্ছেন।
আইনি অভিভাবকেরা শিশুটিকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চাইলেই মূলত সমস্যা দেখা দেয়। ব্যারিস্টার হাফিজ ব্যাখ্যা করে বলেন, আন্তঃদেশীয় দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হেগ কনভেনশন অন প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন অ্যান্ড কো-অপারেশনের সদস্য নয়।
বাংলাদেশের আইন দেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশি শিশুদের সম্পূর্ণ দত্তক নেওয়ার অনুমতি দেয় না। তাই বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশীদের (দ্বৈত নাগরিক) প্রথমে বাংলাদেশে পারিবারিক আদালত থেকে অভিভাবকত্ব পেতে হবে। তারপরে তারা যে দেশে বাস করবে সেখানে শিশুটিকে দত্তক নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আট ধাপের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। বৈধ অভিভাবকত্ব নিতে, ভিসার জন্য আবেদন করতে এবং অবশেষে শিশুটিকে বিদেশে নিয়ে যেতে এক বা দুই বছর সময় লাগতে পারে’।
যদি সম্ভাব্য দত্তক গ্রহণকারী পিতামাতাকে — যারা বিদেশে বসবাস করছেন — আবাসিক দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়, তাহলে তাদেরকে অভিভাবকত্ব প্রক্রিয়ার জন্য প্রত্যাশিত দত্তক গ্রহণকারী সন্তানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করতে হবে। যাতে পরবর্তীকালে অভিভাবকত্ব বা দত্তক নিয়ে কোনও আইনি সমস্যা না হয়।
তারপরে তাদের আইনি অভিভাবকত্বের জন্য পারিবারিক আদালতে আবেদন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে। এসব নথির মধ্যে রয়েে শিশুর জন্মসনদ, জন্ম দেওয়া দম্পতির অনাপত্তি, আবেদনকারী দম্পতির একজন যে বাংলাদেশি নাগরিক তার প্রমাণ এবং এমন নথি যেগুলো বিদেশে বসবাসের সর্বোচ্চ সত্যতা নিশ্চিত করে।
আদালতের সিদ্ধান্তের পর, শিশুর অভিভাবকদের সন্তানের অভিভাবকত্ব-পরবর্তী জন্ম সনদ নিতে হবে। যেখানে তাদের বৈধ অভিভাবক হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ থাকবে।
আর যদি বৈধ অভিভাবক শিশুকে বিদেশ নিয়ে যেতে যান তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি অনাপত্তিপত্র অবশ্যই নিতে হবে। যাচাইবাছাই শেষেই দেওয়া হয় এই অনাপত্তিপত্র।
অন্য দেশে নিয়ে যেতে শিশুর পাসপোর্টের জন্য অনাপত্তিপত্রসহ যাবতীয় সব নথি জমা দিতে হয়। তারপর ভিসা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকাদানের মধ্য দিয়ে যেতে হয় আবেদনকারীকে।
এরপর সে দম্পতিকে তার বসবাস করা দেশের আইন অনুযায়ী শিশুটিকে দত্তক নিতে হয়।
ব্যারিস্টার হাফিজ বলেন, আপনি কল্পনা করতে পারবেন না কতজন দম্পতি সন্তান না থাকায় দত্তক নিতে চায়। বিভিন্ন দেশের দম্পতি বাংলাদেশ থেকে শিশু দত্তক নিতে চায়। কিন্তু জটিল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে তারা সেটা পারে না। আদালতের শুনানির জন্য একজন মানুষ কতবার বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসতে পারবে?
তিনি আরও বলেন, এটা সত্য যে মানবপাচার ও অন্যান্য অপরাধের একটা ভয় থেকে যায়। তবে প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত ও জটিলতামুক্ত হওয়া উচিত।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ সালে দেশে তিন হাজার ৫০০টি বেসরকারি এতিমখানায় ৮৬ হাজার ৪০০ এতিম ছিল। ব্যারিস্টার হাফিজ বলেন, কিন্তু এই সব শিশুই অভিভাবকহীন নয়। তাদের বাবা-মায়ের মধ্যে কেউ একজন হয়তো বেঁচে আছেন। এতিমদের মধ্যে ৫০ শতাংশই ৫-৯ বছল বয়সী। ৮৫টি সরকারি শিশুসদনে আসন আছে ১০ হাজার ৩০০টি।
বাংলাদেশে প্রতি বছর কত শিশুকে দত্তক নেওয়া হয় বা বৈধ অভিভাবকত্বের অধীনে নেওয়া হয় সে সম্পর্কে কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর অনুসারে, গত ২২ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২২৫ শিশুকে যুক্তরাষ্ট্রে দত্তক নেওয়া হয়েছে।
আইন নিয়ে জটিলতা
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আইয়ুব খান মুসলিম পারিবারিক আইনে একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করেন। সে অনুচ্ছেদের মূল কথা হলো, কোনও ব্যক্তি মারা গেলে, তার ছেলে ও মেয়ে সম্পত্তিতে সমান ভাগ পাবে। এমনকি মৃত ব্যক্তির বাবা বেঁচে থাকলেও তার ছেলে ও মেয়ে এ ভাগ পাবে।
বিষয়টি পরে চরম বিতর্কের জন্ম দেয়। কারণ মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে, পুত্রসন্তান কন্যার চেয়ে দ্বিগুণ সম্পদ পাবে। আইন এবং ধর্ম একে অপরের পথে গেলে কী হয় তার উদাহরণ হিসেবে ব্যারিস্টার হাফিজ এই উদাহরণ টানেন।
হাফিজ বলেন, ‘যদি পারিবারিক আইন বা ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিগত আইন সংশোধন করা হয়, তাহলে ধর্মীয় মুসলমান বা হিন্দুরা এতে একমত হবেন না। তাই ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে একটি পৃথক ধর্মনিরপেক্ষ দত্তক আইন নিয়ে আসা ভালো হবে।’
দত্তক গ্রহণের ধর্মনিরপেক্ষ আইনের অধীনে এতিমদের দত্তক নেওয়া যাবে। তাদের দত্তক নেওয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কেননা এটি তাদের সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সহায়তা এবং পিতামাতার স্নেহ দেবে।
হাফিজ বলেন, দত্তক নেওয়ার জন্য কোনো যথাযথ আইন না থাকায়, জন্মের পরপরই হাসপাতাল থেকে শিশু চুরি হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বৈধ অভিভাবকত্বের জন্য আবেদন করার চেয়ে এটি সহজ বলে মনে করে।
কিন্তু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিদ্যমান আইন সমস্যা তৈরি করবে না? এ প্রশ্নের উত্তরে হাফিজ বলেন, ‘অবশ্যই, এটি সমস্যা তৈরি করবে। ধর্মনিরপেক্ষ আইন বলতে অভিন্ন আইনকে বোঝায় যেগুলো প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য হবে, যেমন দণ্ডবিধি বা ফৌজদারি আইন। কিন্তু বিবাহ, উত্তরাধিকার ইত্যাদির মতো পারিবারিক সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে মানুষ অত্যন্ত সংবেদনশীল। আপনি কিছু চাপিয়ে দিতে পারবেন না।
ব্যারিস্টার হাফিজ বলেন, সুতরাং একটি ধর্ম নিরপেক্ষ আইন গ্রহণের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি সহজ, কম জটিল ও দ্রুততর করলে তা সবার জন্য আরও ভালো হবে।