শৈশব লুণ্ঠিত হচ্ছে, শিশুরা বিকশিত হবে কীভাবে

ধরা যাক, যে মেয়েশিশুটি নারিন্দার বিনাত বিবি মসজিদের কোনায় বসে ইফতারি বিক্রি করত, তার কোনো নাম নেই। বেগমগঞ্জ লেনের যে একচিলতে ঘরে তার জন্ম, সেটাও তার ঘর না। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর ছয় বছর বয়স থেকেই সে ‘পরিবারের প্রধান’। তার রোজগারেই মায়ের সংসার চলে। যে বছর বাবা মারা যান, সেই বছর সে দয়াগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। এরপরেও তার সেই স্কুলের কথা মনে পড়ে। ৯ বছরের মেয়েশিশুটি এখন দুটি বাসাবাড়িতে কাজ করে। আর বিকেলে রাস্তার পাশে বসে কখনো হাওয়ায় মিঠাই বা তেলের পিঠা বিক্রি করে।

আজ থেকে দুই বছর পর যখন এই দেশ শিশুশ্রমমুক্ত হবে, তখন কী হবে মেয়েটির? ১১ বছর বয়সে সে তো শিশুই থাকবে। কীভাবে চলবে ছোট দুই ভাই আর অপারেশনের রোগী মাকে নিয়ে মেয়েশিশুটির সংসার?

মাত্র দুই বছরের মধ্যে দেশ থেকে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করার অঙ্গীকার আমাদের আছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের ৮ দশমিক ৭ নম্বরে সেটাই বলা হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংশ্লিষ্ট কনভেনশন ১৩৮ এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার-সংক্রান্ত কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে সরকার। এসব কনভেনশনে শিশুকে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত রাখার কথা বলা হয়। এসব প্রতিশ্রুতি ও বাধ্যবাধকতার আলোকে শ্রম মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে।

কতটা এগিয়েছি

২০২৩ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো খেটে খাওয়া শিশুদের নিয়ে তাদের এক অন্তর্বর্তীকালীন জরিপের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। এই জরিপের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শিশুশ্রম জরিপ ২০২২’। এর আগে ২০১৩ সালে একই শিরোনামে আগের জরিপটা করা হয়েছিল। জরিপে দেখা যাচ্ছে, শিশুশ্রমিকের সংখ্যা গত ১০ বছরে না কমে বরং বেড়েছে। তবে কমেছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা।

শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের তথ্য জানতেই জরিপটি পরিচালনা করা হয়। সারা দেশের ৩০ হাজার ৮১৪ খানা থেকে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ৫ থেকে শুরু করে ১৭ বছর বয়সীদের জরিপে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার। এর মধ্যে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭। শিশুশ্রমে নিয়োজিত ছিল ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন।

বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত-২০১৮) অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না। তবে ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন হালকা কাজ করতে পারবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, দেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ৭০৯টি কারখানার মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, সেখানে মোট ৯ হাজার ১৯৪ জন শ্রমিকের মধ্যে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৮২০ শিশু। এই শিশুশ্রমিকদের অধিকাংশেরই বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। শ্রম আইন সেখানে কেবলই কিছু কাগজ।

ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কোনগুলো

শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশ সরকার ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমকে নির্ধারণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে সেগুলোকে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছে। এ বিষয়ে ২০১৩ সালে গেজেট প্রকাশ করা হয়। গত বছর (২০২২) আরও পাঁচটি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে, তবে সেগুলো নিয়ে কোনো নতুন গেজেট প্রকাশিত হয়নি। ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলে শিশুদের নিউমোনিয়া, কাশি, আঙুলে দাদ, দুর্ঘটনাজনিত দৈহিক ক্ষত, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, হাঁপানি, যকৃতের দুরারোগ্য ব্যাধি, মূত্রাশয় ক্যানসারের মতো রোগ হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। বাংলাদেশের ঝালাই (ওয়েল্ডিং), সড়ক ও পরিবহন, যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা, তামাক কারখানা, ব্যাটারি ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শিশুদের নিয়োজিত থাকার ব্যাপারে জাতিসংঘের শিশু অধিকারবিষয়ক কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে অনেক দিন ধরে।

বিবিএস তাদের জরিপে গেজেটের বাইরে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলোকে আমলে নেয়নি। নিলে হয়তো ফলাফলে আরও বাস্তব অবস্থার ছবি পাওয়া যেত। নানা ফোরামে শিশু গৃহকর্মীদের অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কথা তুলে ধরা হলেও আমলকারীরা বিষয়টিকে পাত্তা দিতে চান না। এবারও জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী হালকা করে আবারও বিষয়টি উত্থাপন করতে গিয়ে বলেন, ‘চারদেয়ালের ভেতরে যে শিশুশ্রম হয়, তাদের বের করে আনতে হবে। বাসাবাড়িতে অনেক বাচ্চা (শিশু পড়ুন) শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।’

রাশেদা কে চৌধূরীকে শিশু গৃহকর্মীদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আজ থেকে বছর সাতেক আগে ২০১৬ সালে ‘ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় আলোচনায় তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু সবাইকে চমকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা এখন থেকে আর আগের মতো গৃহকর্মী পাবেন না। আমরা ৩৮টি কাজকে চরম ক্ষতিকর বলে ঘোষণা করেছি। এতে গৃহকর্মীর বিষয়টিও আনা হবে।’ তখন তিনি প্রচুর হাততালি পেয়েছিলেন। উপস্থিত কয়েকজন শিশু প্রতিনিধি আনন্দে কেঁদেই ফেলেছিলেন।

তাঁরা এখনো কাঁদেন, অসহায় শিশুশ্রমিকদের সেই কান্না কবে থামবে?

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924