করোনায় শিশুর মনস্তাত্বিক পরিবর্তনে পাশে থাকুন
মহামারীর দিনে ঘরবন্দি জীবন বেড়েই চলছে। ছোটবড় সবার স্বাভাবিক যাপিতজীবনে প্রভাব রাখছে কোভিড-১৯। করোনার সংক্রামণ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি, বড়রা যতটা না সামলে নিতে পারছে ছোটরা ততটায় উদ্বিগ্ন হচ্ছে অনিশ্চয়তা ও ভীতিতে। কারণ, যে কোনো পরিবর্তনের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সহজে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারলেও, শিশুদের সেটা বুঝে উঠতে খানিকটা সময় লাগে।
তাই, করোনার দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রভাবে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ যেন বিঘ্নিত না হয়, সে বিষয়ে বাবা-মা’কে সচেতন থাকতে হবে। এবং তাদের বিভিন্ন চাহিদা, অভিযোগ, অনুযোগ, আবদার মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
শিশুর মনস্তাত্তিক পরিবর্তনগুলো যে কারণে হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করলে দেখা যাচ্ছে-
১.শিশুদের স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনা, বাড়ির পাশে খেলা, ছবি আঁকা, নাচ, গান সবকিছুতেই ছন্দপতন ঘটেছে। এমন কি পাশের বাড়ির বন্ধুর সাথে মেশাটাও এখন বন্ধ। লকডাউনে স্কুল ছুটিতে প্রথমদিকে বাচ্চাদের মনে কিছুটা আনন্দ হলেও এখন সেটা পরিণত হয়েছে অস্থিরতায়।
২.বয়ঃসন্ধিকালে থাকা সন্তানদের মাঝে মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনটা বেশি, তাই তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কাটাও বেশি। এদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও যত্নবান হতে হবে পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের।
৩.বাচ্চাদের অনুশাসনের মধ্যে রাখার জন্য কিছু অভিভাবক তাদের ওপর প্রয়োজনাতিরিক্ত বাধানিষেধ আরোপ করেন, এটা কখনো ঠিক নয়। কেউ কেউ বাচ্চাদের সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন, সারাক্ষণ উপদেশ দেওয়া, জোর করে নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দেওয়া, সব সময় স্ট্রিক্ট ব্যবহার করার ফলে তাদের মনের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। পাশাপাশি তাদের আত্মবিশ্বাসও কমে যায়।
৪.ঘরবন্দির এ সময়টাতে অভিভাবকদের ভুলের কারেণ সন্তানেরা হয়ে যাচ্ছে খিটখিটে ও রাগী। তবে রাগ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এটি থাকলে এবং মন শান্ত না হলে গভীর সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এক বছরেরও বেশি সময় ঘরে থেকে থেকে আউটডোর অ্যাক্টিভিটি কমে যাওয়ার পাশপাশি ঠিক কী কী কারণে আপনার আদরের সন্তানরা অনেক সময় রাগ করছে, খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে আবার কখনোবা আক্রমণাত্মক ব্যবহার করছে, সে কারণগুলো জেনে নেওয়া যাক-
১. হতাশা এর প্রধান কারণ। বাচ্চারা যা চায়, তা না-পেলে ক্রমশ তাদের ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
২. জেনেটিক্স ও অন্যান্য জৈবিক কারণ রাগ ও আক্রমণাত্মক স্বভাবের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে পরিবেশেরও ভূমিকা রয়েছে, যেখানটাতে সে বড় হচ্ছে।
৩. বাচ্চাদের মধ্যে রাগের সমস্যা সমাধানের জন্য মা-বাবাকে প্রথমে তাদের রাগের কারণ বুঝতে হবে। এর জন্য ধৈর্য সহকারে বাচ্চাদের কথা শুনতে হবে অভিভাবকদের।
এসব বিষয় সমাধানে করণীয়গুলো কী কী হতে পারে-
১.করোনাভাইরাস নামটি শুনলেই শিশুরা যেন ঘাবড়ে না যায় বরং সেই সচেতনতাটুকু বাড়িয়ে দিন।
২.শিশু সার্বক্ষণিক ঘরে থাকার কারণে পড়াশোনার পাশাপাশি তার ধর্মীয়চর্চা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা এবং সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলুন।
৩.ছবি আঁকা, সুন্দর হাতের লেখার অনুশীলন, ক্রাফট, ফটোগ্রাফি, গান এমনকি অনেক সময় রান্নাতেও তাদের সাহায্য নিন। দেখবেন তারা মজা পাবে।
৪.ডায়রি লিখতে বলুন, দেখবেন নিজের মনের অনুভূতি ব্যক্ত করার সুযোগে তাদের একঘেয়েমি কাটবে।
৫.টিনএজ বয়সের সন্তানদের বড় সম্পদ বন্ধুর শুন্যতাটুকু পূরণ করার চেষ্টা করুন। তাদের সাথে নিজেদের শৈশব কৈশরের গল্প করুন, স্কুল জীবনের মজার মজার ঘটনাগুলা বলুন।
৬. সবসময় বুঝানোর চেষ্টা করুন, অতিমারিতে হতাশ হলে চলবে না। প্রয়োজনে ক্যারাম, লুডু, দাবা খেলুন তাদের সাথে।
৭.মহামারির নেতিবাচক চিন্তায় সন্তানেরা যেন কখনোই ভীষণ একাকী, অসহায়, বিষন্ন, আশাহত অনুভব না করে সে বিষয়ে খেয়াল রাখুন।
৮.এই পরিস্থিতিতে তারা কী ভাবছে এবং কী অনুভব করছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তাদের অনুভূতির প্রকাশটাকে বাধা না দিয়ে শ্রদ্ধা করুন এবং আশ্বস্ত করুন, এই পরিস্থিতিতে তার ভেতরের অনুভতিগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে আপনি সবসময় তার পাশে আছেন।
সবশেষে, বাচ্চাদের আশপাশে ভালোবাসা, যত্ন ও সুখের পরিবেশ গড়ে তুলুন। তাদের বোঝাতে হবে যে তারা নিরাপদে আছে। আর মা-বাবাকে এটা সর্বদা মনে রাখা প্রয়োজন, আপনারা হাসিখুশি থাকলে আপনার সন্তানেরাও হাসিখুশি থাকবে। অতিমারির এই কঠিন সময়টাতেও থাকবে প্রাণোচ্ছ্বল।