করোনাকালে শিশু থাকুক ঝুঁকিমুক্ত

করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সারা বিশ্বের মানুষ একযোগে লড়াই করছে। এর মধ্যে শিশুদের নিয়ে সবার একটু আলাদা টেনশন কাজ করে। কেননা শিশুরাও আছে এই ঝুঁকির মধ্যে।

 

জ্বর হলেই টেনশন!

এই সময় শিশুর জ্বর হলে সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। এই জ্বর করোনাভাইরাসজনিত কভিড-১৯ কি না সে ভয়ে উদ্বিগ্ন থাকে পুরো পরিবার। জ্বর কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র। যেকোনো সময়ই শিশুরা জ্বরে ভুগতে পারে। শিশুদের জ্বর মূলত সংক্রামক অসুখের প্রকাশ, যার বেশির ভাগ সংক্রমণ হয় ভাইরাসজনিত কারণে। আবার ব্যাকটেরিয়া জীবাণু সংক্রমণেও শিশুর জ্বর হয়। সচরাচর  যেসব ভাইরাসজনিত কারণে শিশুর জ্বর দেখা দিতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া নিয়ে শ্বাসতন্ত্রের অসুখ। তবে এখন কভিড-১৯ আক্রান্তের ক্রান্তিকাল চললেও শিশু কিন্তু ডেঙ্গুতেও ভুগতে পারে। এ ক্ষেত্রে জ্বরের সাধারণ লক্ষণের সঙ্গে র‌্যাশ ওঠা এবং একটু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে চোখের ভেতর, মাংসপেশিতে, মাথা ব্যথা থাকতে পারে। আবার কভিড-১৯ হলেও উপসর্গহীন অথবা মৃদু উপসর্গের হতে পারে। ভাইরাসের সংক্রমণে শিশুর জ্বর সাধারণত তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি স্থায়ী হয় না।

 

জ্বর ও সর্দি-কাশি হলে করণীয়

শিশুর জ্বরের সঙ্গে সর্দি-কাশি ও অন্যান্য উপসর্গ থাকলে কিছু প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা ঘরেই নেওয়া যায়। যেমন—

♦ বুকের দুধে নির্ভরশীল শিশুকে ঘন ঘন স্তন্যপান করানো উচিত। এতে জ্বর সেরে যায়।

♦ শাকসবজি, ফলমূলসহ স্বাভাবিক খাবার চালু রাখার পাশাপাশি বেশি করে তরল খাবার ও পানীয় পান করাতে হবে। তবে নানা সুগারসমৃদ্ধ জুস, ড্রিংকস, চিপস, জাংক ফুডস পরিহার করতে হবে।

♦ আলো-বাতাসপূর্ণ ঘরে শিশুকে রাখতে হবে।

♦ বেশি কাপড়চোপড়ে জড়িয়ে না রেখে পাতলা কাপড় পরিধান করাতে হবে।

♦ ঈষদুষ্ণ পানিতে স্পঞ্জিং করাতে পারলে দ্রুত জ্বর নেমে যায়।

♦ লবণ পানি বা নরমাল স্যালাইন ড্রপস দিয়ে নাকের জ্যাম দূর করা যায়।

♦ তুলসীপাতার রস বা লেবু মিশ্রিত পানি পানে কাশি প্রশমিত হয়।

♦ শিশুর বয়স ৩ মাসের কম হলে, ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর হলে, দেহে র‌্যাশ দেখা দিলে, অনবরত কান্না করলে, বুকের দুধ পান বা পানীয় পানে অসমর্থ হলে, সব কিছুই বমি করে দিলে, নেতিয়ে পড়লে, ঘাড় শক্ত বা অজ্ঞান অবস্থা হলে বা খিঁচুনির মতো মারাত্মক লক্ষণ দেখা দিলে শিশুকে তাত্ক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ দিতে হবে।

 

যখন কডিভ পরীক্ষা

শিশুর জ্বর হলেই কভিড নিয়ে টেনশন নয়। চিকিৎসক যদি মনে করেন, শিশুটি করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত অসুখে ভুগতে পারে, তবে তার দেওয়া ব্যবস্থাপত্র মেনে কভিড-১৯-এর পরীক্ষাটি করাতে হবে। চিকিৎসক না বললে পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন নেই।

 

রুটিন টিকাদান কতটা জরুরি?

করোনা পরিস্থিতিতে শিশুকে টিকা দিতে হবে কি না এ নিয়ে অনেক অভিভাবক দুশ্চিন্তায় ভোগেন। অনেকে এই পরিস্থিতিতে শিশুকে টিকাদান কেন্দ্রে নিয়ে যেতেও ভয় পান। তাদের জেনে রাখা দরকার, শিশুর জন্য টিকা অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়। বরং সময়মতো টিকাদানের অভাবে শিশু হাম, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়ার মতো জীবন সংহারক অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর এক-চতুর্থাংশ মারা যায় এসব রোগে।

 

শিশুর কভিড প্রতিরোধে করণীয়

♦ শিশুকে নিরাপদ রাখতে অভিভাবকদের করোনা প্রতিরোধ কৌশল পুরোপুরি মেনে চলতে হবে।

♦ ঘরের ও বাইরের মানুষজন যেন হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব, মাস্কের যথাযথ ব্যবহার করাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং এসব কাজে শিশুদেরও রপ্ত করাতে হবে।

♦ এখন বিশ্বের প্রায় ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে ঘরে অবস্থান করছে। এ সময় তারা মানসিক অবসাদে ভোগার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ জন্য শিশুকে করোনার বা অন্য কোনো ভীতিকর খবর শোনাবেন না। ঘরেই আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করুন।

♦ তাদের নিয়ে মুভি দেখুন, গেম খেলুন, নিয়মিত বই পড়তে উৎসাহিত করুন, বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কল সংযোগে কথাবার্তার সুযোগ সৃষ্টি করে দিন।

♦ সম্ভব হলে তাদের বাগান পরিচর্যার কাজে যুক্ত করুন।

 

শিশুর ইমিউনিটি ঠিক রাখতে

‘ইমিউনিটি’ হলো রোগ প্রতিরোধ শক্তি, যার সাহায্যে দেহে জীবাণু সংক্রমণ রোধ করা যায়। এটি সার্বক্ষণিক দেহে কোনো টিউমার বা ক্যান্সার কোষ, বিজাতীয় যেকোনো কোষকলা তৈরি হওয়ার বিরুদ্ধে সজাগ কার্যক্রম চালিয়ে যায়। দেহে যখনই কোনো রোগজীবাণু প্রবেশ করে তখন এই শক্তি তাকে প্রতি-আক্রমণ করে লড়াই চালিয়ে যায় এবং তাকে ধ্বংস করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে।

 

বাড়ানোর উপায়

কোনো কোনো শিশু জন্মগতভাবে ইমিউনিটির ত্রুটি নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। আবার অপুষ্টিতে ভুগে, এইডসের শিকার হয়েও জন্মের পর অনেক শিশু এই বিশেষ শক্তি হারিয়ে ফেলে। টিকা প্রদান, সুষম খাদ্যাভ্যাস, বিশ্রাম ও শরীরচর্চার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। শিশুর ইমিউনিটি তৈরির প্রধান ধাপগুলো হলো—

 

জন্মগত

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়েই শিশু জন্মগ্রহণ করে। ভ্রূণ মায়ের দেহ থেকে ইমিউগ্লোবুলিন নামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে জন্মায়।

 

মাতৃদুগ্ধ

মাতৃদুগ্ধকে শ্বেত রক্ত বলা হয়। শালদুধে রয়েছে রোগ প্রতিরোধযোগ্য কোষ ও ফ্যাক্টরস। মায়ের দুধে রয়েছে শিশুর প্রয়োজনীয় সব ধরনের ভিটামিনস ও মিনারেলস, যা শিশুকে নানা রোগজীবাণু যেমন ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কান পাকা অসুখ প্রভৃতি থেকে রক্ষা করে। এ জন্য জীবনের প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ পান করলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এরপর অন্যান্য পরিপূরক খাবারসহ কমপক্ষে দুই বছর মায়ের দুধ পান করা উচিত।

 

টিকা

টিকাদানের মাধ্যমে ইমিউনিটি বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। প্রাথমিক টিকাদানে যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, পোলিও, হাম, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগের হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করা যায়। এ জন্য সময়মতো ও নিয়মিত টিকাদান করা উচিত।

 

খাবার

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য খাবার যথা ভিটামিনস ও মিনারেলস শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। যেমন—

ভিটামিন ‘এ’ : বুকের দুধ, গরুর দুধ, মলা ও ঢেলা মাছ, সবুজ শাকসবজি, গাজর ও হলুদ রঙের ফলমূল ইত্যাদি।

ভিটামিন ‘ডি’ : শিশুকে সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টার মধ্যে প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে তিন দিন সূর্যের রোদ লাগালে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘ডি’ পায়। এ ছাড়া ডিম, পোল্ট্রিজাত খাবার থেকেও পাওয়া যায়।

ভিটামিন ‘সি’ ও ‘ই’ : ভিটামিন ‘সি’র অন্যতম উৎস আমলকী, লেবু, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি। পাশাপাশি আয়রন, আয়োডিন, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি খনিজ পদার্থও বাড়ন্ত শিশুর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

তবে যে শিশু প্রতিদিনের খাবারে সব ধরনের খাদ্যপ্রাণ যেমন শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিনস, মিনারেলস, জীবাণুমুক্ত পানীয়, আঁশসহ সব কয়টি উপাদান পায় তার কোনো কিছুর ঘাটতি থাকে না।

 

খেলাধুলা ও ব্যায়াম

খেলাধুলা ও ব্যায়াম ছাড়াও আনন্দদায়ক নিরাপদ পরিবেশ শিশুর রোগ প্রতিরোধের জন্য সহায়ক। এ জন্য বাড়ন্ত বয়সে তাদের খোলা মাঠে খেলাধুলার অভ্যাস করানো উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924