সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত বিশ্বে এক-তৃতীয়াংশ শিশু

সিসার বিষক্রিয়ায় শিশুরা ব্যাপক হারে এবং আগের চেয়ে অজানা মাত্রায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে প্রতি তিনজন শিশুর একজন বা প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে পাঁচ মাইক্রোগ্রাম বা তার বেশি। অর্থাৎ এসব শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখনই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। ৩০ জুলাই ইউনিসেফ ও পিওর আর্থ প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এ ধরনের প্রথম প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এসব শিশুর প্রায় অর্ধেকের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ায়।

‘চিলড্রেনস এক্সপোজার টু লিড পলুশন আন্ডারমিন্স জেনারেশন অব পটেনশিয়াল’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি শিশুদের সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়াবিষয়ক হেলথ ম্যাট্রিক্স ইভাল্যুয়েশনের করা একটি বিশ্লেষণ এবং এটি এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পারসপেকটিভসে প্রকাশের জন্য অনুমোদিত একটি গবেষণার মাধ্যমে যাচাই করা হয়। বাংলাদেশে উন্মুক্ত বাতাসে এবং আবাসস্থলের কাছাকাছি এলাকায় ব্যবহৃত সিসা-এসিড ব্যাটারির অবৈধ পুনর্ব্যবহারকে সিসার সংস্পর্শে আসার একটি প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

ইন্সটিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স ইভাল্যুয়েশনের তথ্যানুসারে, সিসার বিষক্রিয়ায় বিশ্বে যেসব দেশে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, সেই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এবং এ দেশের জনসংখ্যার প্রত্যেকের রক্তে সিসার উপস্থিতির গড় হার ৬ দশমিক ৮৩ মাইক্রোগ্রাম/ডেসিলিটার, যা সর্বোচ্চ হারের দিক থেকে বিশ্বে ১১তম। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বাংলাদেশে মসলায় উচ্চ মাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। হলুদের মান নির্দেশক হিসেবে রং ও ওজন বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত লিড ক্রোমেট শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সমানভাবে রক্তে সিসার মাত্রা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। এক সমীক্ষা অনুসারে, কিছু পণ্যে সিসার উপস্থিতি জাতীয় সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে ৫০০ গুণ পর্যন্ত বেশি পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সিসার ভূমিকার কারণে বাংলাদেশে আইকিউ হ্রাস পাওয়ায় অর্থনৈতিক যে ক্ষতি হয়, তা দেশের জিডিপির ৫ দশমিক ৯ শতাংশের সমান। সিসার বিষক্রিয়া শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের সক্ষমতাকে ব্যাহত করে এবং জীবনে পাওয়া সুযোগগুলোর সর্বাধিক সুবিধা গ্রহণে তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, প্রথমদিকে অল্প কিছু লক্ষণ দেখা দিলেও সিসা নীরবে শিশুদের স্বাস্থ্য ও বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে মৃত্যুর মতো পরিণতিও ডেকে আনে। সিসার দূষণ কতটা বিস্তৃত, তা জানা এবং ব্যক্তিবিশেষ ও কমিউনিটিতে এটি যে ক্ষতি সাধন করে তা বুঝতে পারা শিশুদের সুরক্ষা প্রদানে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণকে অবশ্যই অনুপ্রাণিত করবে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সিসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন যা শিশুদের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটি বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। কারণ, এটি তাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই ক্ষতি করে। এর ফলস্বরূপ তাদের সারা জীবনের জন্য স্নায়ুবিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। শৈশবকালীন সিসাজনিত বিষক্রিয়া মানসিক স্বাস্থ্য ও আচরণগত সমস্যা এবং অপরাধ ও সহিংসতা বৃদ্ধির সঙ্গেও সম্পর্কিত।

পিওর আর্থেও প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ফুলার বলেন, সিসার বিপদ সম্পর্কে লোকজনকে জানানো যেতে পারে, যাতে তারা নিজেদের এবং তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারে।

সিসাযুক্ত জ্বালানি তেল এবং বেশিরভাগ সিসাযুক্ত রঙের ব্যবহার বন্ধ করার পর থেকে উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় রক্তে সিসার মাত্রা নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে। তবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় শিশুদের রক্তে উচ্চমাত্রায় সিসার উপস্থিতি বজায় রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তা বিপজ্জনক মাত্রায় বেশি, এমনকি বৈশ্বিকভাবে সিসাযুক্ত জ্বালানি তেলের ব্যবহার বন্ধের এক দশক পরেও।

প্রতিবেদনে পাঁচটি দেশের কেস স্টাডিতে সিসা দূষণ ও অন্যসব বিষাক্ত ভারি ধাতব বর্জ্য শিশুদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এগুলো হল : বাংলাদেশের সাভারের কাঠগোরা; জর্জিয়ার তিবিলিসি; ঘানার অ্যাগবোগব্লোশি; ইন্দোনেশিয়ার পেসারিয়ান এবং মেক্সিকোর মোরেলস স্টেট। প্রতিবেদনে পরিস্থিতি উত্তরণে বেশকিছু সুপারিশ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হল : রক্তের সিসার মাত্রা পরীক্ষা জন্য সক্ষমতা গড়ে তোলাসহ পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন তৈরির ব্যবস্থা করা; নির্দিষ্ট কিছু সিরামিকস, রং, খেলনা ও মসলার মতো সিসাযুক্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এবং পণ্যের সংস্পর্শে শিশুদের আসা ঠেকানোসহ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেয়া; স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসমূহ যাতে শিশুদের মাঝে সিসার বিষক্রিয়া শনাক্ত, পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত থাকে সে জন্য এগুলো শক্তিশালী করাসহ ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করা; শিশুদের সিসার সংস্পর্শে আসার নেতিবাচক প্রভাবসমূহ আরও ভালোভাবে সামাল দিতে তাদের জন্য বিস্তৃতি শিক্ষা ও মানসিক আচরণগত থেরাপি প্রদানের ব্যবস্থা করা; সিসার সংস্পর্শে আসার বিপদ এবং এর উৎসসমূহ সম্পর্কে নিয়মিত গণশিক্ষামূলক প্রচার চালানো; বাবা-মা, স্কুল ও কমিউনিটি নেতারা এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে সরাসরি আবেদন জানানোসহ জনসচেতনতা ও আচরণ পরিবর্তন করা; সিসা অ্যাসিড ব্যাটারি ও ই-বর্জ্য উৎপাদন ও পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করার জন্য পরিবেশগত, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা মানদণ্ড গড়ে তোলা, বাস্তবায়ন এবং প্রয়োগ করা; ধাতু গলানোর কার্যক্রমের জন্য পরিবেশগত এবং বাতাসের মানবিষয়ক নিয়মকানুন কার্যকর করাসহ আইন ও নীতিমালা করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924