সম্ভাবনার দাড় খুলতে বন্ধ হোক শিশুশ্রম

বাংলাদেশে ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের কাজে নিয়োগ দেয়া আইনত নিষিদ্ধ৷ তবে সেই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না৷ ফলে কমছে না শিশুশ্রম, যা শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর৷

গত জুনে ঢাকায় এক পথশিশুর সঙ্গে দেখা হয়৷ সংসদ ভবনের সামনের সড়কে বড় বড় গাড়ি যখন ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ায় তখন সে সেসব গাড়ির দরজার কাছে গিয়ে ভিক্ষা চায়, বয়স হয়ত দু’বছরও হবে না তার৷ আমি দেখে আঁতকে উঠেছিলাম৷ এত ছোট্ট বাচ্চাকে তো গাড়ির চালকদের পক্ষে দেখা সহজ নয়৷ যে কোনো মুহূর্তে গাড়ি চলতে শুরু করলে সে হয়ত পড়তে পারে কোনো দুর্ঘটনায়৷ তখন কী হবে!

বিদেশে কয়েক বছর থাকায় হয়ত হঠাৎ করে এমন দৃশ্য আমার কাছে অস্বাভাবিক, আতঙ্কের মনে হয়েছে৷ কিন্তু মেয়েটির মাকে দেখেছি নির্বিকার বসে থাকতে পাশের ফুটপাতে৷ প্রতিবার সিগন্যালে গাড়ি থামার পর ভিক্ষা করতে রাস্তায় নামে মেয়েটা, আবার গাড়ি চলতে শুরু করলে ফিরে যায় মায়ের কাছে৷ রুটিন কাজ৷ কিন্তু মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ৷

সাতচল্লিশ লাখ শিশু শ্রমিক

বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ কম নয়৷ ইউনিসেফ-এর হিসেবে দেশটিতে পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সি শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত ৪৭ লাখ৷ এদের মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ আমার দেখা শিশুটি সম্ভবত এই হিসেবের বাইরে৷ তার বয়স কোনোভাবেই পাঁচ নয়৷ আর ভিক্ষাবৃত্তি কোনো পেশা নয়৷ ফলে ইউনিসেফ-এর হিসেবের বাইরেও আরো অনেক শিশু আছে যারা ভিক্ষা করছে, অথবা কাজ করছে৷ প্রকৃত সংখ্যাটা তাই আরো অনেক বেশি মনে করি আমি৷

শিশুশ্রম কি প্রয়োজন?

বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে অনেকে হয়ত বলবেন, শিশুশ্রম থাকা উচিত৷ কেননা এ সব শিশু টিকে আছে পরিশ্রম করে৷ কাজ না করলে তাদের খাওয়াবে কে? দেখবে কে? তাছাড়া তাদের পরিবারও টিকে আছে তাদের আয়ের উপর৷ মোটের উপর গৃহকর্মী হিসেবে এসব শিশু কাজ করলে সেটা অনেক পরিবারের জন্যও ভালো৷ আমার কাছে এ সব যুক্তি শিশুশ্রমের যৌক্তিক কারণ মনে হয় না৷ একটা শিশুকে কাজের মধ্যে ঠেলে দিয়ে একটা সুন্দর সম্ভাবনাকে কার্যত শুরুতেই মাটি চাপা দেয়া হয়৷ আর এর দায় আমাদের সবার, এবং অবশ্যই জনগণের প্রতিনিধি সরকারের৷

শিশুশ্রম শিশুর যে ক্ষতি করে

প্রশ্ন উঠতে পারে, শিশুশ্রম কেন ক্ষতিকর? কাজ করবে এর মধ্যে আবার ক্ষতির কী আছে? ক্ষতিটা মানসিক এবং শারীরিক৷ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুরা মূলত কাজ করে এমন সব প্রতিষ্ঠানে যেগুলোর আনুষ্ঠানিক তেমন কোনো ভিত্তি নেই৷ এ সব প্রতিষ্ঠানে কাজের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই, নিয়মকানুন মানার বিধিনিষেধ নেই, কোনটা শিশুর জন্য ক্ষতিকর তা বিবেচনার ব্যবস্থা নেই৷ এমন পরিবেশে কাজ করে শিশুরা অল্প বয়সেই বিভিন্ন রোগের কবলে পড়ে যায়৷ পরিশ্রমের ক্লান্তির কারণে, পর্যাপ্ত সময় না থাকায় লেখাপড়া থেকে কার্যত ছিটকে পড়ে৷

শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে শিশুরা প্রতিনিয়তই নিগ্রহেরও শিকার হচ্ছে৷ গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকবার দেখেছি৷ বাংলাদেশে কিছু মানুষ সম্ভবত শিশুদের নির্যাতন করে একরকম পৈচাশিক আনন্দ লাভ করেন৷ সর্বশেষ এক ক্রিকেটার এবং তাঁর স্ত্রীর হাতে নির্যাতনের শিকার এক গৃহকর্মীর ছবি দেখে আমার তাই মনে হয়েছে৷ আমরা সেই নির্যাতন দেখেছি বলে আঁতকে উঠছি, কিন্তু এ রকম হয়ত আরো অনেক গৃহকর্মী প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়ে বেড়ে উঠছে, যাদের দেখার কেউ নেই৷ শিশুশ্রম বন্ধ না হলে এমন নির্যাতন বন্ধ হবে না বলেই আমার ধারণা৷

ভবিষ্যত ধ্বংসের সহজ উপায়

শিশুদেরকে শিশুশ্রমে নিয়োগ করে কার্যত তাদের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে৷ কেননা অল্প বয়সে কাজ করতে গিয়ে তারা লেখাপড়ার সুযোগ হারাচ্ছে, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ আর শিশুদের বৃদ্ধির যে স্বাভাবিক পন্থা, সেই পন্থা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ তারা এমন সব কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে যেগুলো তাদের বয়সে করার কথা স্বাভাবিক অবস্থায় ভাবাই যায় না৷

শিশুশ্রম বন্ধে তাহলে করণীয় কি?

সমস্যার সমাধান না দিয়ে লেখা শেষ করা উচিত নয়৷ বাংলাদেশের আইনেই আছে ১৪ বছরের কম বয়সিদের কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে না৷ আমি মনে করি, এই আইনের প্রয়োগ করতে হবে কঠোরভাবে৷ এখানে সরকারের দায়িত্ব অনেক৷ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে শিশুশ্রম বন্ধ করে সেসব শিশুকে লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া, তাদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে, বিনিয়োগ করতে হবে৷ প্রয়োজনে শিশুদের উপর নির্ভরশীলদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে৷ এক্ষেত্রে জাগো ফাউন্ডেশনের মতো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ মনে রাখতে হবে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *