শিশু বিকাশে ‘প্যারেন্টিং’ শিক্ষা
এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে প্রাক-শৈশবকাল শিশুর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, এর ব্যাপ্তিকালের প্রারম্ভ মাতৃগর্ভের ভ্রূণাবস্থা থেকে শুরু করে প্রায় ৮ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়েই একটি শিশু তথা মানুষের পরবর্তী জীবন গঠনের মূল ভিত তৈরি হয়।
প্রাক-শৈশবকালে মানুষের পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র তথা ‘মস্তিস্ক’ গঠিত হয়। মস্তিস্ক গঠনের সামান্যতম ব্যত্যয় ব্যক্তির এবং ক্ষেত্রবিশেষে তার পুরো পরিবারের জন্য চরম দুর্ভোগ বয়ে আনতে পারে। আবার শিশুর মস্তিস্ক সুন্দরভাবে গঠিত হলে প্রত্যাশা করা যায়, সেই শিশু পরবর্তী জীবনে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে এবং ভালো কিছু করার সামর্থ্য অর্জন করবে। এ ছাড়া শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরেই মস্তিস্ক গঠনের ৮০ শতাংশ এবং ৫ বছর বয়সের মধ্যে প্রায় পরিপূর্ণ গঠন (৯০ শতাংশ) সম্পন্ন হয়। এ অবস্থায় প্রতি সেকেন্ডে ৮০০ থেকে ১ হাজার নিউরন একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত হয়। আর নিউরন হচ্ছে মস্তিস্ক গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা একক। যে কারণে এই সময়টি মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত।
গোটা বিশ্ব যখন শিশুর বিকাশের এই সময়কে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছে এবং ‘প্যারেন্টিং এডুকেশন’ প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে নানাভাবে ত্বরান্বিত করে চলেছে; তখন আমাদের দেশের সিংহভাগ বাবা-মা ও যত্ন প্রদানকারী এ ব্যাপারে অসচেতন।
প্রাক-শৈশবকালীন যত্ন হচ্ছে বাবা-মা, পরিবার, সমাজ সর্বোপরি দেশের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ; যা কখনোই ব্যয় নয়। এ সময় বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঠিক যত্ন ও পরিচর্যাই পারে শিশুর জীবনের শুভ সূচনা করতে। এই যত্ন ও পরিচর্যার শুরুটা হবে শিশুর গর্ভে থাকা অবস্থা থেকে বা কিছু ক্ষেত্রে গর্ভে আসার পূর্ব থেকেই, যখন মা-বাবা শিশুর নিরাপদ আগমনের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক, মানসিক, পুষ্টিগত ও পরিবেশগত প্রস্তুতি নেবে।
শিশু গর্ভে আসার পর থেকে দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে। শিশু গর্ভাবস্থায় থেকেও যে আমাদের কথা শুনতে পায় এবং প্রতিক্রিয়া করতে পারে, তা আমাদের জানতে হবে। এ সময়ে গর্ভের শিশুর সঙ্গে বেশি বেশি কথা ও গল্প করা অতীব দরকার। মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের এও জানা উচিত, গর্ভকালে একজন মাকে কোন কোন টিকা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে নিতে হবে এবং তা কখন; স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে, যাতে অন্তঃসত্ত্বাকে অন্যেরাও সহায়তা এবং সঠিক সময়ে টিকা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। সময়মতো টিকা নেওয়া ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা গর্ভের শিশুকে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারে।
শিশুর বয়সভিত্তিক নির্দিষ্ট সূচক প্রতিনিয়ত অর্জন করছে কিনা, তা নির্ধারণকল্পে প্রত্যেক মা-বাবাকেই প্রথমত এই সূচকগুলো সম্পর্কে জানতে হবে এবং তা অর্জনে তাঁদের আদরের শিশুকে সাহায্য করতে হবে। ০-৬ মাস বয়সী শিশুর পাশে রঙিন খেলনা রাখা যেতে পারে, যাতে সে চিৎ হয়ে পাশ ফিরে দেখতে ও ধরতে আগ্রহী হয় এবং চেষ্টা করে। চার-পাঁচ মাস বয়সী শিশুকে প্রতিদিন কারও তত্ত্বাবধানে কিছু সময়ের জন্য উপুড় করে শুইয়ে রাখা, যাতে সে চিৎ হয়ে শুতে পারে এবং চিৎ অবস্থা থেকে পাশ ফেরা রপ্ত করতে পারে। ৫-৬ মাস বয়সী থেকে পিঠে হাত রেখে শিশুকে বসতে সহায়তা করা ইত্যাদি। এ ধরনের অসংখ্য প্যারেন্টিং আচার-আচরণ আছে, যা পরিবারে শিশু উন্নয়নে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে বাবা-মা ও পরিবারের সব সদ্যদেরই জানা খুব জরুরি।
মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সামান্য সচেতনতাই পারে শিশুকে বড় ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা, বিপদ ও প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশ তথা শিশুর বিকাশের চারটি ক্ষেত্রেই প্রত্যাশা অনুযায়ী বিকাশে প্রয়োজনীয় সহায়তা বাবা অথবা মা কারোরই একার পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তার জন্য চাই সবারই শিশু লালনপালনে সমান অংশগ্রহণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মাত্র ১৩ শতাংশ বাবা শিশু লালনপালনে অংশগ্রহণ করে এবং মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ লোকই মনে করে, শিশু লালনপালন মূলত মায়ের কাজ। বাবা তথা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের কাজ ততটা মুখ্য নয়।
প্যারেন্টিং এডুকেশন সম্পর্কে সর্বজনীন সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে এবং যা স্বল্প ব্যয়ে বিভিন্ন উপায়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এই যেমন- স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবী কাজের অংশ হিসেবে সম্পৃক্ত করে ক্যাসকেড মডেলের (স্রোতধারার মতো) দ্রুত ব্যাপকভাবে বিস্তরণ করা সম্ভব। ক্যাসকেড মডেলের মধ্যে কয়েকজন নেতা থাকেন, ঁযারা কোনো একজন দক্ষ প্রশিক্ষকের কাছ থেকে প্যারেন্টিং এডুকেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানবেন। এর পর তাঁদের অর্জিত তথ্য, জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আশপাশের মা-বাবা ও অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করবেন। এ ধরনের জ্ঞানীয় আদান-প্রদান শুধু একদিন বা এক মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি চলমান প্রক্রিয়া।
ব্যানবেইসের তথ্যমতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের ২ কোটি ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৬ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। এই বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে অর্ধেক সংখ্যক শিক্ষার্থীকেও যদি কার্যকরভাবে প্যারেন্টিং এডুকেশন বিস্তরণে সম্পৃক্ত করা হয়, তাহলে দেশের সব মানুষের কাছে প্যারেন্টিং এডুকেশনের তথ্য অতি সহজে ও অল্প সময়ে পৌঁছে যাবে। এ ছাড়া সরকার প্যারেন্টিং এডুকেশনের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারণে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিতে পারে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তা খুব সহজেই আশা করি পেয়ে যাবে। পাশাপাশি প্রতি বছর সেরা প্যারেন্ট সম্মাননা বা সেরা প্যারেন্টিং এডুকেশন স্বেচ্ছাসেবক পুরস্কারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যা অন্যদের প্যারেন্টিং এডুকেশনের সঙ্গে আরও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করবে।
মো. রমজান আলী: ম্যানেজার, আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট (ইসিডি), প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ