শিশু নির্যাতন বন্ধে অগ্রাধিকার জরুরি

দেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতি দিনকে দিন নাজুক হচ্ছে। শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, করোনাকালীন সংকটে পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে পড়া এবং অপরাধের বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে শিশুদের প্রতি নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। শিশুহত্যা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, বলাৎকার, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এখন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার ধরনও। প্রান্তিক কিংবা বস্তিতে জন্ম নেওয়া শিশুদের অবস্থা আরও করুণ। প্রান্তিক শিশুরা ঘরে-বাইরে দুই জায়গাতেই নির্যাতিত হয়। অন্যদিকে, শিক্ষার অধিকারসহ ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুরা শ্রমিক, টোকাই, চোরাকারবারিদের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে এবং বড় অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। একদিকে সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে থাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিশু নির্যাতন ও শিশুহত্যার মতো অপরাধ বাড়ছে, অন্যদিকে শিশু আইনের প্রয়োগ ও প্রশাসনিক নানা দুর্বলতায় শিশুর সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

শিশু নির্যাতনের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে শিশুরা তাদের সঙ্গে সংঘটিত অপরাধ বেশিরভাগ সময় অভিভাবককে জানাতে পারে না। অনেকে জানানোর মতো অবস্থায় থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে শিশু অবুঝ হওয়ায় নির্যাতনের শিকার হয়। শিশু অবলা এবং তাদের ভয় দেখানো সহজ এ মানসিকতায় অপরাধীরা তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। আর শিশু নির্যাতন করেও বড়রা নানাভাবে পার পেয়ে যায় বিধায় সমাজে শিশু নির্যাতন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টায় না। লক্ষ করবার মতো বিষয় হলো, ইদানীং বলাৎকারের ঘটনা বাড়লেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে ছেলেশিশু বলাৎকার বা নির্যাতনের শিকার হলেও সেটি যেন প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণ নয়। তাই ছেলেশিশু বলাৎকারের প্রতিকারও দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে আর অপরাধও বাড়ে। একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে দিন দিন মেয়েশিশু ধর্ষণের সংখ্যা ও প্রবণতা দুটোই বাড়ছে। দেশের শিশু নির্যাতন পরিস্থিতির ধারণা পাওয়া যাবে মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে। আসক-এর তথ্যমতে, ২০২০ সালের ১২ মাসে ৪৯০ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এ সময়ে আত্মহত্যা করেছে ৯১ শিশু। এক বছরে বিভিন্ন বয়সী ১ হাজার ৭১৮ শিশু ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ১৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ছয় বছরের কম বয়সী ১১৬ শিশু ধর্ষণের নির্মমতার শিকার হয়েছে। একই সময়ে ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ২৭৯ শিশু। এক বছরে বলাৎকারের শিকার হয় ৫২ ছেলেশিশু। এ ধরনের পাশবিকতায় তিন শিশুর মৃত্যু হয়। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয় ১০ শিশু।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নে পক্ষভুক্ত। এছাড়া শিশুর সুরক্ষায় ২০১৩ সালের শিশু আইনে নানা দিকনির্দেশনা রয়েছে। দেশে শিশুর প্রতি অপরাধের বিচার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। শিশু আইনের নবম অধ্যায়ে শিশুর প্রতি বিশেষ অপরাধগুলোর দণ্ড সম্পর্কে বলা আছে। কোনো ব্যক্তি যদি তার হেফাজতে কোনো শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ করে কিংবা অশালীন আচরণ করে শরীরের কোনো অঙ্গের ক্ষতি করে তাহলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া কোনো শিশুকে অবৈধ ও অপরাধজনক কাজে ব্যবহারের শাস্তি তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। শিশু আইনের দশম অধ্যায়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর বিকল্প পরিচর্যার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া শিশুদের কল্যাণে দেশের সব জেলা, উপজেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় এক বা একাধিক প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ, প্রতিটি জেলা-উপজেলায় ‘শিশু কল্যাণ বোর্ড’ গঠন, প্রতিটি থানায় একটি করে শিশুবিষয়ক ডেস্ক স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। যেখানে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ‘শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা’ হিসেবে গণ্য হবেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো, যারা শিশুদের অধিকার রক্ষা করবে সেই প্রশাসন ও পুলিশ শিশু আইনের বিধান অনুযায়ী এখন পর্যন্ত জেলায়, উপজেলায় প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়নি, আইন অনুযায়ী প্রতিটি থানায় শিশু সুরক্ষা ডেস্ক রাখার কথা থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি।

শিশুহত্যা ও শিশু ধর্ষণের মতো ফৌজদারি মামলা সরকার চাইলে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দিতে পারে। কিন্তু সারা দেশে ৫৪টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিধান অনুসারে সেখানে ১৮০ দিনের সময়সীমায় বিচার শেষ হচ্ছে না। শিশু নির্যাতন ও শিশু হত্যার এই নির্মম সংকট উত্তরণে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তিতে আদালতের বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিশু আইন অনুসারে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ এবং প্রতিটি থানায় শিশু সুরক্ষা ডেস্ক চালু করার বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *