শিশু-কিশোরের মানস গঠনে করণীয়

বিয়ে একটি ধর্মীয় সম্পর্ক। পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসাময় এই সম্পর্কের পূর্ণতা নিয়ে আসে সন্তান। সন্তানের মধ্যে বাবা-মা খুঁজেন নিজেদের অস্তিত্ব। তাই তো সন্তানের কল্যাণের কথা ভেবে, সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে বাবা-মা সংসার জীবনের ঘটে যাওয়া পরস্পরের মনোমালিন্য মিটিয়ে নেন, একে অপরের ভুলক্রটি ক্ষমা করে দেন, সন্তানের সামনে এমন কোনো আচরণ প্রকাশ করেন না- যা সন্তানের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত, সুস্থ ও সম্পূর্ণ পরিবারের সন্তানদের থেকে অসুস্থ ও ভাঙা পরিবারের সন্তানরা সবক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে। এটা শুধু বিবাহবিচ্ছেদের কারণে হচ্ছে, এমনটা নয়। পিতা-মাতার আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব ইত্যাদি সন্তানদের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে। তাই সন্তানের সামনে এমন কোনো আচার-ব্যবহার করা যাবে না, যা শিশুর মনে আঘাত দেয়- তার মনোজগতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। শিশুদের প্রকৃতি কোমল হওয়ায় তারা নানা ধরনের অপছন্দনীয় স্বভাব থেকে মুক্ত থাকে। সেখানে কোনো ধরনের কলুষতা জায়গা পাক, মন্দ আচরণ বিচরণ করুক, খারাপ কথার প্রতিধ্বনি ঘটুক তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শিশু-কিশোরদের মনটা এমন, শৈশব কিংবা কৈশোরে তাদের যা শেখানো হয়- সেটাই পরে সারা জীবনের জন্য শক্ত ভিতের কাজ করে। তাই এ সময়ে তাদের মনে নৈতিক শিক্ষার ভিত রচনা করে দিতে হবে। জীবনের সঠিক পথে চলার দিশা দেওয়ার জন্য শৈশব ও কৈশোর হচ্ছে উপযুক্ত সময়। এ সময় তাদের মধ্যে অনুকরণ ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে বেশি। তাই বাবা-মায়ের উচিত তার শিশু ও কিশোর সন্তানদের জন্য সুস্থ ও পবিত্র পরিবেশ গড়ে তোলা। তাদের জন্য গড়ে তুলতে হবে এমন পরিবেশ যেখানে থাকবে দয়া-মায়া ও ধৈর্যসহ পছন্দনীয় নানা গুণ। আসলে শিশু-কিশোরদের প্রতিপালন মানে তাদের খাবার, পোশাক ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নয়, তাদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতাসহ নানা ধরনের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো ও তাদের জন্য পছন্দনীয় নানা গুণ অর্জনের পথ খুলে দেওয়া জরুরি। এসব লক্ষ্য অর্জনে বাবা-মা ও অভিভাবক এবং শিক্ষকদের উচিত শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বিশেষভাবে যতœশীল হওয়া ও একই লক্ষ্যে পর্যাপ্ত মাত্রায় সময় দেওয়া।

শিশুর বিকাশের দুটি দিক, শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ। শিশুর শারীরিক সুস্থতা ও বৃদ্ধির পাশাপাশি তার মানসিক বিকাশের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। শারীরিক বৃদ্ধি মানে শিশুর দৈহিক উন্নতি ও সুস্থতা; আর মানসিক বিকাশ হচ্ছে- শিশুর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, আচার-আচরণ, ভাষার প্রকাশ, বোধশক্তি, অনুভূতি, ভাবের আদান-প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্রমিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়া। শিশুদের আদর-স্নেহ করা, তাদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, গল্প করা, খেলাধুলা করা; ছড়া, কবিতা শোনানো, তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা, আনন্দ দান ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটে। শিশুকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া, ভয় দেখানো, ধমক দেওয়া, রাগ করা বা অবহেলা করা হলে তার মেধাগত দক্ষতার বিকাশ ব্যাহত হয়। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা সন্তানদের স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো এবং উত্তম আচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ -সুনানে তিরমিজি

বাবা-মার স্নেহ বঞ্চিত হয়ে অনেক শিশু হতাশা, অবসাদ ও নানা মনোবৈকল্যের শিকার হয়। অনেক শিশু নিরানন্দ একাকিত্বে বিভিন্ন গেমে আসক্ত হয়, অভিভাবকদের অসচেতনতায় অনেকে বিপথগামী হয়ে মাদককে সঙ্গী বানায়। এমন জটিল পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। নবী করিম (সা.) শত ব্যস্ততার মধ্যেও শিশু নাতি হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হুসাইন (রা.)-এর সঙ্গে ঘোড়া ঘোড়া খেলতেন, তারা নবী করিম (সা.)-এর নামাজে সিজদার সময় ঘাড়ে-পিঠেও চড়ে বসতেন। সৃজনশীল কাজে শিশুদের উৎসাহ দিতে হবে। তাদের সঙ্গে কোনো ওয়াদা করলে, তা পূরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘শিশুদের স্নেহ করো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো। তোমরা তাদের সঙ্গে কোনো ওয়াদা করলে তা পূরণ করো। কেননা তাদের দৃষ্টিতে তোমরাই তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করছ।’ -মুসনাদে আহমাদ

এ কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই, মানসিক প্রশান্তি, চারিত্রিক উন্নতি ও নৈতিক দৃঢ়তার নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী মাধ্যম হলো- ধর্মশিক্ষা। তাই শিশুদের ধর্মশিক্ষা, তথা কোরআন শিক্ষা, অর্থসহ কোরআন শিক্ষা, নামাজের দোয়া-দরুদ, সুরা-কেরাত মুখস্থ করা ও অর্থসহ শেখার ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে তাদের ধৈর্য ও ত্যাগের মনোভাব শেখানো খুবই জরুরি। ধৈর্য শিশু-কিশোরদের অপেক্ষাকৃত বেশি প্রশান্ত ও দয়ালু করে তোলে। পবিত্র কোরআনে ধৈর্য শব্দটি ৭২ বার এসেছে। ধৈর্য মানুষের ব্যক্তিত্ব ও সুপ্রবৃত্তিগুলোকে শক্তিশালী করে, যা মুমিন হওয়ার জন্য অপরিহার্য। নানা বিপদ ও প্রতিকূলতার মোকাবিলায় ধৈর্য মানুষকে শক্তি জোগায়। শিশু-কিশোররা জন্ম থেকে ধৈর্যশীল হয় না, তাদের ধৈর্য ধরার প্রশিক্ষণ দিতে হয়। শিশু-কিশোররা বড়দের অনুসরণ করে। অপছন্দনীয় যেকোনো পরিস্থিতিতে বাবা-মা যদি শিশুদের সামনে ধৈর্যহীন কোনো আচরণ করেন, তাহলে সে রকম পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোররাও অনুরূপ আচরণ করবে। তাই শিশুদের ধৈর্য শেখানোর আগে বাবা-মাকে এ বিষয়ে অগ্রণী হতে হবে। শিশুদের সামনে মারমুখী ও অধৈর্যশীল আচরণ করা যাবে না। শেখ সাদি (রহ.) বলেছেন, ‘যেসব শিশু-কিশোর কমবয়সে নৈতিক আচার-আচরণ সংক্রান্ত ভালো গুণগুলো রপ্ত করেছে, তারা ভবিষ্যৎ জীবনে বেশি সুস্থ থাকে এবং অন্যদের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী ও অন্যদের চেয়ে তাদের সামাজিক সম্পর্ক বেশি শক্তিশালী হয়। এ ধরনের শিশু অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভালোভাবে টিকিয়ে রাখতে পারে এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন বেশি সুখময় হয়।’

লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *