শিশু-কিশোরদের সাইবার সচেতন করতে হবে

বর্তমান বাস্তবতায় ইন্টারনেট আমাদের নিত্যসঙ্গী। এখন আমাদের সন্তানরাও ইন্টারনেট সুবিধাকে পড়াশোনা কিংবা অনলাইন ক্লাসের জন্য ব্যবহার করছে। আবার এই ইন্টারনেট সুবিধাই শিশু-কিশোরদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় শিশু-কিশোররা নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়ছে। বেশ কয়েক বছর আগে বুকার পুরস্কার বিজয়ী লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসন সতর্ক করেছিলেন, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যতের একটি প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে। ব্রিটেনের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য ইনডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে জ্যাকবসন বলেছিলেন, স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমাণে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কারণে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। আর এসবের কারণে তারা হারাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাসও।

ইদানীং শিশু-কিশোররা বই পড়ার চেয়ে শর্টকাট পদ্ধতিতে অধ্যয়নে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। কোনো কৌতূহল তৈরি হলে ইন্টারনেট থেকে সহজেই এর সমাধান করে ফেলছে। এতে অনেক ক্ষেত্রেই তারা লাভবান হচ্ছে। আবার প্রকারান্তরেই যে ওই শিশু ইন্টারনেটনির্ভর হয়ে উঠছে—সেটি নিয়ে আমরা মোটেও ভাবছি না। আগে একসময় বই পড়া, পত্রিকা পড়া আমাদের নিত্য রুটিন ছিল। আমাদের শিশুরাও সেটিতেই অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু ইদানীং আমাদের সবারই সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইল হাতে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক খবর বা তথ্যনির্ভরতা বাড়ছে। আমাদের শিশুরাও একই প্রবণতায় নিমগ্ন হচ্ছে।

উপরোল্লিখিত প্রতিবেদনে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জানান, শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, তিনি নিজেও বইয়ের প্রতি আর তেমন মনোযোগ দিতে পারেন না। কারণ তাঁর মনোযোগের একটা বড় অংশও চলে যায় স্ক্রিন টাইমের পেছনে। তিনি বলেন, ‘আমি আগে যে পরিমাণ বই পড়তে অভ্যস্ত ছিলাম, এখন আর পড়তে পারি না। আমার মনোযোগ চলে যায় ইলেকট্রনিক সব পর্দার দিকে। আমি সাদা কাগজ চাই, কাগজের ওপর আলো চাই।’

এই লেখকের মতামতকে আমরা যদি সবাই নিজের জীবনে একটু মিলিয়ে দেখি, তাহলে প্রায় সবার জীবনেই একই প্রভাব লক্ষ করা যায়। ওই লেখকের মতামত যে যথার্থভাবে আমাদের সমাজ জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি সত্যিকার অর্থেই বই পড়া কিংবা নিয়মিত পত্রিকা পড়া থেকে নিজেদের ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলে, তাহলে সত্যিই একটি ভয়াবহ মূর্খতা আগামী দিনে একটি প্রজন্মকে গ্রাস করতে পারে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষার মান অনেক নেমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে কিশোর বয়সীদের মধ্যে একাকিত্বের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। তারা একা থাকছে এবং ডিজিটাল ডিভাইসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমনির্ভর হয়ে উঠছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বর্তমান সময়ে শিশু-কিশোরদের ভেতরে ইন্টারনেটভিত্তিক গেমস ও নানা ভিডিও দেখার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। গ্রাম পর্যায়েও শিশু-কিশোরদের মধ্যে টিকটক আর লাইকি নিয়ে উন্মাদনা বেড়েছে। বখাটেপনা ও নানা ধরনের অনৈতিক কাজও কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার দমবন্ধ পরিবেশে দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া দিনের বেশির ভাগ সময় ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কম্পিউটার স্ক্রিনে আর ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ট্যাবে সময় ব্যয় করে। এই আসক্তির মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তা ব্যবহার করেছে অনলাইন ক্লাসের জন্য। আর ৪০ শতাংশ কার্টুন, নাটক ও চলচ্চিত্র দেখে, ২৭ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার এবং ১৭ শতাংশ আসক্ত বিভিন্ন গেমসে। এই গবেষণা প্রতিবেদন থেকেই কিছুটা অনুমান করা যায় যে শিশুরা ইন্টারনেট শুধু অনলাইন ক্লাস কিংবা পড়াশোনাতেই ব্যবহার করছে না, তারা ফেসবুক এবং গেমসের জন্যও ব্যবহার করছে।

প্রাথমিকের গণ্ডি পার না হওয়া এক শ্রেণির শিশু থেকে শুরু করে উঠতি বয়সীদের হাতে হাতে এখন অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোন। স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট হাতের মুঠোয় থাকায় সহজেই পর্নো ভিডিওসহ অশ্লীল ও অনৈতিক ভিডিও দেখার সুযোগ অনায়াসেই পেয়ে যাচ্ছে অপরিণত বয়সীরা। আর এসব শিশু-কিশোরই একটু বড় হলে জড়িয়ে যাচ্ছে নানা অপকর্মে।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের যেভাবে পরিচর্যা করা হবে, সেভাবেই তারা বড় হবে। আমাদের সবার উচিত শিশুদের নৈতিকতা, মানবতা, সততা, শ্রদ্ধাবোধ, সৃজনশীলতা শিক্ষা দেওয়া। শিশু নরম কাদার মতো থাকে কৈশোর পর্যন্ত। কাজেই শিশু বয়স থেকে কৈশোর পর্যন্ত শিশুর দিকে আমাদের অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হয় যথাসম্ভব। শিশুরা ইন্টারনেট থেকে সব কিছু ভালো পাবে—এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। অনেক খারাপ বিষয় যে শিশুরা গ্রহণ করতে পারে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। আমাদের সন্তানরা রাত জেগে পড়াশোনা করছে, নাকি ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করছে—সে বিষয়ে সজাগ থাকার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশুদের যথাযথভাবে বড় করতে পারলে আগামী দিনের দেশ হবে জঞ্জালমুক্ত এবং নিরাপদ। আজকের শিশুই যখন আগামী দিন নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, যথাযথ মূল্যবোধ ধারণ করে—তাহলে সমাজে অন্যায়-অন্যাচার অনেকাংশেই কমে যাবে।

সুতরাং আমাদের প্রত্যেককেই ইন্টারনেট বা সাইবার জগতের খারাপ দিকগুলার অপকারিতা সম্পর্কে জানাতে হবে, সন্তানদের সচেতন করে তুলতে হবে। সাইবার আইন সম্পর্কে নিজে জানতে হবে ও সন্তানকে জানাতে হবে এবং নিজের শিশুসন্তানের হাতে আপনার ডিভাইসটা তুলে দেওয়ার আগে নিজে ভেবে দেখুন কখন এটা তুলে দেওয়ার উপযুক্ত সময়।

মূলত পরিবারের অসচেতনতার কারণেই শিশু-কিশোররা বখাটে হচ্ছে। অপরিণত বয়সে মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাধা না দেওয়ায় দিন দিন মোবাইল ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। নিয়মিত বই পড়া এবং পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠছে না। লেখাপড়া থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে। কাজেই লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসনের মন্তব্য ‘টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যতের একটি প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে’—বাক্যটি মাথায় রেখে আমাদের সবাইকে সচেতনতার বলয় তৈরি করা উচিত।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *