শিশু আয়াতের চিকিৎসায় এক ইনজেকশনের দাম ২২ কোটি টাকা!
বিরল রোগ ‘এসএমএ’-এ আক্রান্ত হয়ে ভুগছে সিলেটের ছোট্ট শিশু আয়াত হক। এ রোগ নিরাময়ে ‘রিসডিপ্লাম’ নামে মুখে খাওয়ার ওষুধ রয়েছে। প্রতিমাসে খাওয়াতে হয় ১০ লাখ টাকার ওষুধ। আর এ ওষুধ খাওয়াতে হবে আজীবন।
‘এসএমএ’ প্রতিরোধক ইনজেকশন রয়েছে। তবে এ ইনজেকশনের যে দাম সে টাকার ব্যবস্থা করা শিশু আয়াত হকের বাবা-মায়ের পক্ষে অসম্ভব। ইনজেকশনের দাম ২২ কোটি টাকা। সন্তানকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেছেন বাবা-মা মোহাম্মদ জুনেদ হক ও ফারজানা আক্তার দম্পতি।
শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সিলেট জেলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ আবেদন জানান তারা।
সিলেট নগরের মেজরটিলা ইসলামপুরের ব্লক সি-এর ৭৯ নম্বর বাসার বাসিন্দা জুনেদ ও ফারজানা সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ২০২২ সালের ২০ জুন তাদের দ্বিতীয় সন্তান (মেয়ে) আয়াত হকের জন্ম হয়। জন্মের কিছুদিন পরই তারা লক্ষ্য করেন, আয়াতের হাত-পা অস্বাভাবিক তুলতুলে নরম এবং এগুলো নাড়াতে পারছে না। ঘাড়ও শক্ত নয়, সোজা করতে পারছে না। এছাড়া শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হয় আয়াতের।
এসব দেখে সিলেটের কয়েকজন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন জুনেদ-ফারজানা দম্পতি। পরবর্তীসময়ে তাদের পরামর্শে ঢাকার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে আয়াতকে নিয়ে যান।
প্রাথমিক চেকআপে ওই চিকিৎসক জানান, আয়াত ‘স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাটরোফি’ বা ‘এসএমএ’ নামের বিরল রোগে আক্রান্ত। এসময় তিনি কয়েকটি পরীক্ষা করাতে বলেন। এরমধ্যে একটি ‘এসএমএ’ রোগ শনাক্তের পরীক্ষা। এ পরীক্ষার জন্য আয়াতের শরীরের রক্ত প্রসেস করে ভারতে পাঠানো হয়। কারণ এ পরীক্ষা দেশে হয় না।
একমাস পর পরীক্ষার রিপোর্ট আসে। রিপোর্ট দেখে ওই চিকিৎসক জুনেদ ও ফারজানাকে নিশ্চিত করেন, আয়াত ‘এসএমএ’ রোগেই আক্রান্ত। টাইপ ওয়ানে আছে সে। যেটি এ রোগের মারাত্মক ধরন। এক থেকে দুই বছরের মধ্যে চিকিৎসা না করালে আয়াতকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়। তবে এর কোনো ওষুধ দেশে নেই।
সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসকদের বরাতে জুনেদ ও ফারজানা জানান, পেশির সঞ্চালনকে নিয়ন্ত্রণ করে যে মোটর নিউরোন, তা নষ্ট হওয়ায় জিনঘটিত এ বিরল রোগের কারণ। রোগের তীব্রতা অনুযায়ী টাইপ ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত হয় ‘এসএমএ’ রোগ। বাংলাদেশে এর কোনো ওষুধ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে একটি কোম্পানি কয়েক মাস আগে এর ওষুধ বাজারে নিয়ে এলেও তা কেনা সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত।
বর্তমানে ‘এসএমএ’ প্রতিরোধক ইনজেকশনের দাম ২২ কোটি টাকা। এছাড়া এ রোগ নিরাময়ে ‘রিসডিপ্লাম’ নামের মুখে খাওয়ার ওষুধ রয়েছে। তবে প্রতিমাসে খাওয়াতে হয় ১০ লাখ টাকার ওষধু। আর খাওয়াতে হয় আজীবন। চিকিৎসকের এমন কথা শুনে তারা দুজন দিশেহারা হয়ে যান। একপর্যায়ে তাদের সন্তান আয়াতকে নিয়ে যান ‘এসএমএ’ রোগ বিশেষজ্ঞ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজির চিকিৎসক ডা. জোবায়দা পারভিনের কাছে।
তিনি জুনেদ ও ফারজানাকে পরামর্শ দেন, ‘নোভার্টিস’ নামের বিদেশি ওষুধ কোম্পানি বরাবর একটি আবেদন করার জন্য। কোম্পানিটি প্রতি বছর লটারির মাধ্যমে বিশ্বের ‘এসএমএ’ আক্রান্ত দুই শিশুকে ২২ কোটি টাকা দামের ‘জোলগেনসমা’ নামের ইনজেকশনটি বিনামূল্যে দিয়ে থাকে। ডা. জোবায়দা পারভিনের পরামর্শের পর তারা ‘নোভার্টিস’ কোম্পানি বরাবর আবেদন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে এ দম্পতি আরও বলেন, ‘আবেদন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু সারা বিশ্বের আবেদনকারীদের মধ্য থেকে তারা লটারির মাধ্যমে দুই শিশু নির্বাচিত করে। এখন লটারিতে আমাদের আয়াতের নাম উঠবে কি না সেটা তো বলা যায় না। যদি না ওঠে তবে কি চোখের সামনেই আমাদের সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে? মা-বাবা হয়ে সে দৃশ্য আমরা সহ্য করবো কীভাবে? আমার আয়াত যখন শ্বাসকষ্টে ভোগে তখন কষ্টে আমাদের বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। অনেক সময় ৩-৪ মিনিট পর্যন্ত সে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারে না। আমরা তখন কান্নাকাটি করি।’
তারা আরও বলেন, ‘আমরা দেশের মানুষ জানি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন মানবিক সরকারপ্রধান। মানবিকতার ক্ষেত্রে তিনি অনন্য। তিনি কোটি কোটি টাকা খরচ করে করোনার টিকা বিদেশ থেকে নিয়ে এসে দেশের মানুষকে সম্পূর্ণ ফ্রি দিয়ে যে সুনাম কুড়িয়েছেন তা পৃথিবীর আর কোনো সরকার করতে পারেনি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, একমাত্র আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি চান তবে ফান্ড তৈরি করে আমার আয়াতসহ এ বিরল রোগে আক্রান্ত দেশের শিশুদের তিনি বাঁচাতে পারেন।’
‘যদি আমরা বাবা-মা দুটি করে চারটি কিডনি বিক্রি করে হলেও আমাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের আয়াতকে বাঁচাতে পারতাম, তবে চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমাদের কিডনিসহ সব সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করেও তো ২২ কোটি টাকা ব্যবস্থা করতে পারবো না। তাই বাধ্য হয়ে আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দৃষ্টি আকর্ষণ করছি সিলেট ও প্রবাসে থাকা সিলেটি বিত্তশালী ব্যক্তিদের। যদি সবাই আন্তরিক হন তবে হয়তো আমাদের আয়াতকে বাঁচানো সম্ভব’, যোগ করেন জুনেদ-ফারজানা দম্পতি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান ও হেপাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বিরল রোগের ওষুধ বাংলাদেশে অ্যাভেইলেবল নয়। তবে একটি আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানি এ বিরল রোগের ইনজেকশন ও ট্যাবলেট তৈরি করেছে, যা খুবই ব্যয়বহুল। ইনজেকশনের দাম ২২ কোটি টাকার কিছু কমবেশি হবে। তবে নোভাটিজ নামের ওই বৈশ্বিক ওষুধ কোম্পানি লটারির মাধ্যমে একটা বাচ্চাকে ফ্রি ইনজেকশন দিয়ে থাকে। কিছুদিন আগে ঢাকার একটা বাচ্চা ইনজেকশন পেয়েছে বলে শুনেছি।’