শিশু : আইনি ও ইসলামী দৃষ্টিকোণ

অর্থাৎ, ইয়াকুব আ.-এর পরিবার থেকে দীনের যে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছিল তার ওয়ারিস হবে এবং সে আলো কখনো নির্বাপিত হতে দেবে না। সন্তান কামনায় আরও একটি প্রার্থনা থেকে সন্তানের মর্যাদা ও মূল্য যে কত বেশি তা স্পষ্ট হয়ে যায়। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য এমন জুড়ি ও সন্তান-সন্ততি দান কর, যারা হবে আমাদের জন্য নয়ন শীতলকারী এবং আমাদেরকে কর মুমিন-মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণযোগ্য নেতা।’’ ‘‘আল-কুরআন, ২৫:৭৪।’’ আরও একটি প্রার্থনা- ‘‘হে আমার প্রভু! তুমি তোমার নিকট থেকে আমাকে পবিত্র সন্তান দান কর। অবশ্যই তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী। ‘‘আল-কুরআন, ৩:৩৮।’’ সু-সন্তান দুনিয়াতে যেমন মান-মর্যাদার মাধ্যমে তেমনি পরকালীন জীবনেও অফুরন্ত সওয়াব ও পুরষ্কারের মাধ্যম হয়ে থাকে। কারো জীবদ্দশায় যদি শিশু-সন্তানের মৃত্যু হয় এবং সে ইহলোকে যদি সবর ও ধৈর্যের সাথে শোক সহ্য করে, তাহলে ঐ শিশু-সন্তান আখেরাতের প্রত্যাশিত জান্নাতের ওসিলা এবং বিপুল সম্মানের অধিকারী হবে। তার জন্য জান্নাতে এক বিশেষ মহল তৈরি হবে এবং ঐ মহলের নাম হবে ‘শোকরের মহল’ বায়তুল হামদ। আবু মূসা আল-আশআরী রা. বলেন, নবী স. বলেছেন- ‘‘যখন কোন বান্দার শিশু-সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ ফিরিশতাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা আমার বান্দার শিশু সন্তানের রূহ কবয করে নিয়েছো? ফিরিশতারা জবাব দেন, জী-হাঁ, কবয করে নিয়েছি। আল্লাহ বলেন, তখন আমার বান্দা কি বলেছে? ফিরিশতারা জবাব দেন, প্রভূ! তোমার বান্দা তোমার প্রশংসা করেছে।’’ এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন- ‘‘আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী’’ ‘‘আল-কুর’আন, ২:১৫৬।’’ পড়েছে। একথা শুনে আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে তাঁর বান্দার জন্য জান্নাতে একটি মহল তৈরির এবং সে মহলের নাম ‘শোকরের মহল’ রাখার নির্দেশ দেন।’’

হাদীসের অন্যান্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, শিশু-সন্তান পিতা-মাতার জন্য জান্নাতের সুপারিশকারী হবে। পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও সু-সন্তানের আমল এমন এক সাদকা হিসেবে পরিগণিত হবে, যার সওয়াব দুনিয়ায় থাকা পর্যন্ত তাদের আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। হাদীস থেকে জানা যায় মৃত্যুবরণ করার সাথে সাথে মানুষের আমলের সুযোগ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সে যদি সু-সন্তান রেখে যায় তাহলে তা এমন এক নেক আমল হবে যার সওয়াব লেখা হতে থাকে অনন্তকাল। উপরিউক্ত কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, ইসলামের দৃষ্টিতে শিশু-সন্তানের মর্যাদা ও মূল্য অপরিসীম।
ইসলামী নীতিদর্শনে শিশুর গুরুত্ব : ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় পারিবারিক জীবনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দান করা হয়ে থাকে। কেননা সমাজ-ব্যবস্থার মূখ্য উপাদান পরিবার। পরিবার গঠিত হয় স্বামী-স্ত্রী, মাতা-পিতা ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে। পবিত্র প্রশান্তিময় দাম্পত্য জীবনের উষ্ণ আবেদন ঘন সান্নিধ্যের ফলশ্রুতি হলো শিশু-সন্তান। তাঁর দয়ার, কল্যাণে, স্নেহ-মমতার ফলশ্র“তিতেই গড়ে উঠেছে এ মায়াময় বিশ্ব-সংসার। দাম্পত্য জীবনে কেবল যৌন জীবনের পরম শান্তি, পারস্পরিক অকৃত্রিম নির্ভরতা ও পরিতৃপ্তিই চূড়ান্ত লক্ষ নয়। বরং মানব বংশ রক্ষাকারী সদ্যজাত শিশু-সন্তানদের আশ্রয়দান, তাদের সুষ্ঠু প্রতিপালন, সুরক্ষা এর পরম ও বৃহত্তম লক্ষের অন্যতম। শিশু হচ্ছে সুসংবাদ ও সৌভাগ্যের পরম প্রাপ্তি। পবিত্র কুরআনে হযরত যাকারিয়া আ, ও তাঁর বৃদ্ধ বয়সের সন্তান ইয়াহইয়া আ.-এর প্রসঙ্গ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘‘ওহে যাকারিয়া! আমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি এক পুত্র সন্তানের; যার নাম হবে ইয়াহইয়া। ইত:পূর্বে আর কাউকেই এ নামধারী করিনি।’’ ‘‘আল-কুরআন, ১৯:৭।’’
ইসলাম যে শিশু-সন্তানের প্রতি কত বেশি গুরুত্বারোপ করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় আল্লাহ তাআলার শিশুর নামে শপথের মধ্যে। আল্লাহ নিজেই শিশুর নামে শপথ করেছেন এভাবে- ‘‘না, আমি এ নগরীর নামে শপথ করে বলেছি, যখন তুমি এ নগরীতে অবস্থান করছো। আর শপথ করছি জন্মদাতার নামে এবং তার ঔরসে জন্মপ্রাপ্ত শিশু-সন্তানের নামে। ‘‘আল-কুরআন, ৯০:১-৩।’’ শিশুদের অপরিসীম গুরুত্বের কারণে মহানবী স.-এর হৃদয় জুড়ে ছিল শিশুদের প্রতি প্রবল ভালবাসা ও স্নেহ-মমতা। তিনি বলেন- ‘‘তোমরা শিশুদের ভালবাসো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো।’’ ‘‘করিম, সিরাজুল, মহানবীর শিশু প্রীতি, ঢাকা: রুমা প্রকাশনী, ১৯৯০, পৃ. ২০।’’
তিনি আরো বলেন- ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করে না এবং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না, সে আমাদের কেউ নয়।’’ ‘‘তিরমিযী, ইমাম, আস-সুনান, বৈরূত: দারু ইহইয়ায়িত্-তুরাছিল আরাবী, ১৪২১ হি. খ. ৪. পৃ. ৩২১।’’ মক্কা বিজয়ের পর রসূলুল্লাহ স. যখন বিজয়ী বেশে মক্কানগরীতে প্রবেশ করেন, তখন উটের উপর তাঁর সাথে ছিল একজন শিশু এবং একজন কিশোর। শিশুটি ছিলো রসূলুল্লাহ স.-এর বড় মেয়ে জয়নাব রা.-এর শিশু পুত্র আলী রা. ও কিশোরটি ছিল উসামা রা.। নবী নন্দীনী ফাতিমা রা.-এর শিশু পুত্র হাসান ও হুসাইন রা.-কে রসূলুল্লাহ স. যে কত গভীর ভালবাসতেন ইতিহাসে এর বহু ঘটনা উল্লেখিত আছে। রসূলুল্লাহ স.-এর এ শিশু প্রীতি কেবল নিজ পরিবারের বা অতি প্রিয় সাহাবীদের শিশুর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না সকল শিশুর ব্যাপারেই তাঁর ছিল সমান দরদ। নবী স/ শিশুদের কান্না শুনতে পেলে সালাত সংক্ষিপ্ত করে দিতেন এবং বলতেন- ‘‘আমি সালাত দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছায় দাঁড়াতাম, কিন্তু যখন কোনো শিশুর কান্না শোনতাম তখন সালাত সংক্ষিপ্ত করতাম যাতে মায়ের কষ্ট না হয়।’ ‘‘বুখারী, ইমাম, আস-সহীহ, অধ্যায়: আল-আযান, অনুচ্ছেদ: মান আখাফফাস্-সালাতা ইনদা বুকাইস সাবিয়ী, প্রাগুক্ত, খ. ১ পৃ. ২৫০।’’
হাদীসে আরো আছে- ‘‘একবার আকরা ইবনে হাবিস রা. রসূসুল্লাহ স.-এর নিকট এসে দেখতো পেলেন যে, তিনি তাঁর দুই নাতি ইমাম হাসান ও হুসাইনকে চুমু দিচ্ছেন। তিনি নবী স.-কে বললেন, আপনি আপনার মেয়ের ছেলেদরে চুমু দিচ্ছেন? আল্লাহর শপথ! আমার দশ দশটি সন্তান রয়েছে, এদের কাউকেই আমি কোনো দিন চুমু দেইনি। তখন রসূলুল্লাহ স. তাকে বললেন- ‘‘আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে রহমত ছিনিয়ে নিয়েছেন, তাতে আমার কি দোষ?’’ ‘‘মুসলিম, ইমাম, আস-সহীহ, অধ্যায়: আল-ফাদায়েল, অনুচ্ছেদ: রহমাতু রসূলিল্লাহ স. আস্-সিবইয়ানা …….., প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ১৮০৮।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *