শিশুর যত্নে কিছু ভুল এবং মারাত্মক প্রভাব

শিশুটা ঘুরছে ফিরছে আর তার মায়ের আঁচল ধরে জেদ করছে, এক পর্যায়ে শিশুটা হসপিটালের করিডোরে শুয়ে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে দিলো। দূর থেকে দেখে এতোটুক আন্দাজ করাই যাচ্ছে যে, কোনো জিনিস না পাওয়াতে শিশুটার জেদ ক্রমশ বেড়েই চলেছে এবং স্বাভাবিক ভাবেই শিশুটার মা বেশ বিব্রত বোধ করছে। এক মধ্যবয়ষ্কা মহিলা সহ্য করতে না পেরে বলেই ফেললেন “আহা! শিশুটা যা চাচ্ছে তা দিয়ে চুপ করিয়ে দিন তো!”

ব্যাস! সব সমস্যার সমাধান। শিশুও চুপ, বাচ্চার মায়েরও শান্তি, আশেপাশের মানুষগুলোরও শান্তি। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো আর কিছুদিন পর। শিশুর কিছু দরকার হলেই জুড়ে দেয় কান্না, কেঁদেও জিনিসটা না পেলে মা’কে বিব্রত করার একটা সুযোগও ছাড়ে না। মা’কেও অগত্যা তার অহেতুক জেদ মানতে হয়, সাধ্যের বাইরে যেতে হয়। কিন্তু একটা সময় সাধ্য হার মানে সাথে মা’ও। সমাজ তখনও মা’কেই দোষারোপ করে। অথচ এই সমাজের সামনে বিব্রত না হওয়ার জন্যই কিন্তু শুরুটা হয়েছিলো।

No description available.এই সমস্যার সমাধানটা কিন্তু খুবই সহজ, তবে এর গোড়াপত্তনটা কোথায় সেটা একটু ঘেটে বের করা জরুরি। ব্যাপারটা অনেকটা শেকলের মতো। একটা আরেকটার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত আর কি!

শুরুটা হয় মূলত মাতৃত্বের যাত্রা দিয়েই। একটা নতুন সম্ভাব্য মা! সামনে হাজারটা প্রশ্ন, হাজারটা সমস্যা এবং দুই হাজারটা সমাধান। সব মিলিয়ে একাকার অবস্থা। নবজাতক দুনিয়াতে আসার সাথে সাথে মায়ের দুনিয়া পাল্টে দেওয়া হয়।এমনিতেই শরীরের ভেতর স্ট্রেস হরমোনসহ আরো হাজারটা অজানা হরমোন নিজেদের চমৎকার দেখাতে থাকে তার ওপর শিশুকে কিভাবে সহীহ্ ভাবে লালন পালন করতে হয় তার ১০১ টা উদাহরণ সামনে নিয়ে এসে টানিয়ে দেওয়া হয়। অথচ এই সময়টাতে শতকরা ৮৫% নতুন মায়েরা প্রসবোত্তর বিষন্নতায় ভোগে। অকারনে কান্না পায়, রাগ হয়, ক্ষোভের জন্ম নেয়, পর্যাপ্ত ঘুম হয় না। এর থেকেই আস্তে আস্তে মাতৃত্বের ওপর অনিহার জন্ম হয়,খানিকটা ভয়ও পেয়ে যায়। এই সময়টা প্রচন্ড স্পর্শকাতর। ঠিক যেনো একটা নবজাতককে দুনিয়াতে আনতে যেয়ে জলজ্যান্ত আরেকটা নবজাতকের সূচনা হয়। একদম সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর মতোই মায়েরও প্রচুর যত্নের প্রয়োজন হয়। এই সময়টা শারীরিক এবং মানসিক উভয়ভাবে নতুন মায়ের পাশে থাকা উচিত। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সময় নারীরা প্রশ্নবিদ্ধ হয় “আমাদের সময়ে তো এমন ছিলো না?”

এরপর শুরু হয় শিশুকে খাওয়ানোর পর্ব। ওয়ার্কিং মাদার হোক কিংবা হাউজওয়াইফ এই এক জায়গায় এসে সমস্ত পেরেশানির এক নতুন জন্ম হয়। “শিশু কিছুই খায় না! এটা খায় না, সেটা খায় না, কিছুই খায়না।” এখন উপায় কি? আমাদের তো শিশু দরকার, একটা পুতুল শিশু যে কিনা সবরকম খাবার খাবে, পারলে একাই খাবে। সমস্যাটা হলো এটাও তো ওকে শেখাতে হবে, কিন্তু ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ। এতো সময় কই! ঢের দায়িত্ব আছে কাধে। ওর খাবার প্র্যাকটিসিং করতে গেলে বাকি কাজ মাথায় উঠবে। তার থেকে একটু কার্টুন দেখুক, তাড়াতাড়ি খাবে। ও খুশি আমিও খুশি। শিশু খায় ঠিকই কিন্তু কি খায় জানে না, কিছুদিন পর দেখা গেলো বাচ্চা খাবার গেলার কথা ভুলে মোবাইল গিলছে। মেবাইল নিয়ে নিলে তার ভয়াবহ চিৎকারে বাসায় টেকা দায় হয়ে যাচ্ছে। দিন যায় আচরন আরো খারাপ হতে থাকে। বাসায় গেস্ট আসলে অত্যাচার,বাইরে বেড়াতে গেলে অত্যাচার, মা রান্না করতে গেলে অত্যাচার। সব শেষে সমাধান একটাই “মোবাইল”।

No description available.কিন্তু কিছুদিন পর খেয়াল হলো শিশুর বয়স চার কিন্তু বাচ্চা কথা বলে না। মানুষ দেখলে রেগে যায়, এক কোনায় বসে থাকে, হাসে না, ঠিকমতো কাঁদেও না! ঘুমের মধ্যেও প্রলাপ তার একটাই ” আমার মোবাইল চাই”। সমস্যা দিনদিন গুরুতর হতে থাকলে বাবা মা ডাক্তারের শরণাপন্ন হলো। কিন্তু হসপিটালেও একই ঘটনা। তার জেদ নিবারন করার টোটকা হিসেবে মধ্যবয়ষ্কা ভদ্রমহিলা যা বলেছিলেন তা ভালোই কাজ করতে লাগলো। কিন্তু গোড়ায় গলদ রয়েই গেলো, টোটকা আর কতোদিন?

আসলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যেগুলো আমাদের সবসময়ই মাথায় রাখা উচিত –

১. গর্ভাবস্থার একদম শুরু থেকেই সম্ভাব্য মাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে পজিটিভ ভাবে অবগত করতে হবে। তার জীবনের পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে জানান দিতে হবে। একটা শিশুকে দুনিয়াতে আনতে গেলে নিজেকে ঠিক কতোটুকু প্রস্তুুত হতে হবে তার একটা পূর্ব ধারনা থাকলে পরবর্তীতে দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে সমস্যা কিছুটা কম হবে।

২. সত্যি বলতে একটা শিশুকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাবা মায়ের ভূমিকা ৫০/৫০ হওয়া উচিত। অনেকটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাচ্চার পেছনে সমানভাবে অবদান রাখার চেষ্টা করা উচিত। একইভাবে পরিবারের বাকি সদস্যদেরকেও এই ব্যাপারে সহযোগী মনোভাবের হতে হবে। মা যদি শিশুকে কোনোকিছু দিতে না চায় কিংবা করতে নিষেধ করে তাহলে বাকি সদস্যদেরকেও ব্যাপারটা এড়িয়ে চলতে হবে। নতুবা বাচ্চা মায়ের পরবর্তী আশ্রয়স্থল পেয়ে যাবে এবং পরবর্তীতে মায়ের কোনো নির্দেশনাকেই গ্রাহ্য করবে না।

৩. শিশুরা কাঁদবে,জেদ করবে, দুষ্টামি করবে এটাই বাচ্চাদের বৈশিষ্ট্য। কাজেই শিশু কাঁদলে দ্রুত থামানোর জন্য অহেতুক কোনো ইচ্ছাই পূরন করা যাবে না।শিশুকে বুঝতে দিতে হবে তার চাওয়ামাত্র সবকিছু দেওয়া হবে না। তার উল্টোপাল্টা জেদকে পশ্রয় দিলেই সেগুলো দিনদিন বাড়তে থাকবে। কাজেই এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে বাচ্চার অহেতুক চাহিদা এবং জেদ দুটোকেই এভোয়েড করা। কারন শিশুরা খুব ভালোমতোই জানে বিব্রত করতে পারলেই আমাকে থামানো হবে। এবং এই সময়ও একইভাবে পরিবারের সবাইকে একমত পোষন করতে হবে। পরিবারের ভেতরের পরিবেশ একটা শিশুর সার্বিক বিকাশে সবথেকে বেশি ভুমিকা রাখে।

৪. শিশুকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাছে নিয়ে খেলার মাধ্যমে বয়স অনুযায়ী সামাজিক শিক্ষা দিতে হবে। পাবলিক প্লেসে নিয়ে যেয়ে সচরাচর প্রয়োজন হয় এমন কিছু ব্যাসিক ম্যানার শেখাতে হবে। স্কুলে দেওয়ার আগে অবশ্যই বাচ্চাকে গুড টাচ/ ব্যাড টাচ সম্পর্কে ধারনা দিতে হবে। শিশুদেরকে ধাপে- ধাপে বাইরের পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলা শেখাতে হবে। একবারে কিংবা একদিনে কোনোকিছুই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বাবা মায়ের যৌথ চেষ্টা দ্রুত এবং দীর্ঘস্থায়ীভাবে কাজ করে থাকে।

৫. অতিথি আসলে শিশু জ্বালাতন করবে দেখে মোবাইল দিয়ে ব্যাস্ত না রেখে সামনে যেতে দিন। অপ্রয়োজনীয় কথা বললে বিব্রত হওয়ার প্রয়োজন নেই, তবে খেয়াল রাখবেন আপনার কোনো আচরনে যেনো বাচ্চা বিব্রত না বোধ করে। যেমন জোড় করে কবিতা আবৃত্তি করতে বলা অথবা গান গেয়ে শোনানোর জন্য জোড়াজোড়ি করা। এতে করে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চারা লজ্জা পায় এবং পরবর্তীতে আর কারোর সামনেই নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করতে চায় না। কাজেই ওকে সময় দিন, সময়মতো নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করার ক্ষমতা একাই চলে আসবে।

৬. প্রতিটা মানুষেরই খাবারের প্রতি চাহিদা থাকে। স্বাভাবিকভাবেই শিশুদেরও আছে। কাজেই ছয়মাসের সাথে সাথে ওর খাবারের নিয়ন্ত্রণ ওর হাতে দিয়ে দিন। যতটুক নিজ ইচ্ছায় খায় খেতে দিন।খাবারটাকে চিনতে শেখা জরুরি। মোবাইল হাতে দিয়ে ১ বাটি ভাত খাওয়ালেই বাচ্চার গ্রোথ বাড়বে না বরং শিশুর মস্তিষ্কে খাবারকে নিয়ে পুরো ধারণাটাই উল্টে যাবে। পরবর্তীতে সে জানবেও না সে কোন খাবারটা খেতে চায়। বর্তমানে বাংলাদেশে বেবি লেড উইনিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই প্রক্রিয়াটার মূল উদ্দেশ্য ছয় মাস বয়স থেকে শিশুদেরকে নিজে থেকে খাবার গ্রহনে আগ্রহী করে তোলা। যা পশ্চিমা দেশ গুলোতে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত এবং অনেক জনপ্রিয়।

৭. সবথেকে জরুরি ব্যাপার হলো শিশুগুলোকে প্রাকৃতিক গতিতে বাড়তে দিন,আটকাবেন না। ছোট ছোট পায়ে কেবল হাটতে শিখেছে, সে তো ছুটবেই! লাগাম হাতে থাকলেই যে টানতে হবে তার তো কোনো মানে নেই। সাবধানে ছেড়ে দিন। মানুষের সাথে মিশুক, বাবার কাধে উঠুক, অতিথিদের সামনে যেয়ে আবোল তাবোল বলুক,রাস্তায় জেদ করুক। শুধু ওর বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে শেখাতে থাকেন, সাথে নিজেও শিখতে থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *