শিশুর কাশি-শ্বাসকষ্টের রোগ নিউমোনিয়া ও ব্রংকিওলাইটিস

বিশ্বে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। যদিও নিউমোনিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ।

ফুসফুসে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে নিউমোনিয়া হয়। ফুসফুসের একদিকে বা উভয় অংশকে এ জীবাণু আক্রান্ত করতে পারে। নিউমোনিয়ার জীবাণু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসনালির মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং বায়ুথলিতে এসে বাসা বাঁধে। এর ফলে, বায়ুথলিগুলোতে শ্লেষ্মা, পুঁজ ও অন্য তরলের সৃষ্টি হয় এবং জমা হয়। এ কারণে শ্বাসকষ্ট হয়। নিউমোনিয়ার সাধারণ উপসর্গ হলো কাশি, অনেক ক্ষেত্রে গাঢ় শ্লেষ্মাযুক্ত কফ থাকতে পারে। কফ সবুজ, বাদামি বা রক্তের ছিটেযুক্তও হতে পারে। সাধারণ লক্ষণ হলো-

* কাশি।

* জ্বর।

* দ্রুতগতি ও ঘনঘন ভারী শ্বাসপ্রশ্বাস।

* শ্বাসের সঙ্গে শো শো শব্দ।

* ক্লান্তি বা দুর্বলতা ও ঝিমুনি ভাব।

চিকিৎসা

নিউমোনিয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা করা যায়। যদি তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)-এর বেশি হয়, তবে জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে। কখনো কখনো চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে। শীরায় বা ইন্ট্রাভেনাস অ্যান্টিবায়োটিক এবং শ্বাসযন্ত্রের থেরাপি (শ্বাসপ্রশ্বাসের চিকিৎসা) যেমন কফ ও শ্লেষ্মা বের করা, নেবুলাইজার ও অক্সিজেন দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়।

প্রতিরোধ

নিউমোনিয়া প্রতিরোধের জন্য কার্যকরী ভ্যাকসিন আছে। সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করতে নিুলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-

* বাচ্চার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে স্তন্যপান করানো অপরিহার্য।

* ঘরের পরিবেশ শুষ্ক, উষ্ণ গরম এবং ভালো বায়ু চলাচল থাকা আবশ্যক।

* সর্দি, ফ্লু বা অন্য সংক্রমণ রয়েছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে হবে।

* সময়মতো টিকা দিয়ে দিতে হবে।

ব্রংকিওলাইটিস

নিউমোনিয়া ছাড়াও দুই বছরের কম বয়সি শিশুদের কাশি ও শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ হলো ব্রংকিওলাইটিস। ব্রংকিওলাইটিস হলে কাশিসহ শ্বাসকষ্ট হয়। অনেকেই একে নিউমোনিয়া বা হাঁপানি মনে করেন। ব্রংকিওলাইটিস রেসপিউরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস সংক্রমণজনিত শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ। তবে ইনফ্লুয়েঞ্জা-প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা, এডিনো ও রাইনো ভাইরাস কখনো কখনো এ রোগ সৃষ্টি করে। সাধারণত দুই মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হেমন্তের শেষ থেকে শীতের শুরু অবধি শ্বাসতন্ত্রের এ সংক্রমণ অর্থাৎ ব্রংকিওলাইটিস দেখা যায়। তবে ব্রংকিওলাইটিস তিন থেকে নয় মাসের বাচ্চাদেরই বেশি হয়। এছাড়া সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশু অর্থাৎ অপরিণত শিশু (Premature), যেসব বাচ্চা মায়ের বুকের দুধ খায় না এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করে তাদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

ব্রংকিওলাইটিসের লক্ষণ এবং উপসর্গ

প্রথমে আক্রান্ত শিশুর নাক দিয়ে পানি পড়ে, তারপর আস্তে আস্তে কাশি শুরু হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। শ্বাসকষ্ট হলে বুকের খাঁচা বা পাজর শ্বাস নেওয়ার সময় দেবে যায় এবং শিশু ঘনঘন বা দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করে। শ্বাস নেওয়ার সময় বুকে শাঁইশাঁই বা বাঁশির আওয়াজের মতো শব্দ শোনা যায়। শিশুর দুধ টানতে বা খেতে কষ্ট হয়। অক্সিজেনের স্বল্পতার জন্য ঠোঁট, জিহ্বা নীল বা বেগুনি বর্ণ হয়ে যায়। এ লক্ষণগুলোর মধ্যে যে কোনোটি থাকলেই অবিলম্বে শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখান।

নিউমোনিয়া থেকে ব্রংকিওলাইটিসের পার্থক্য

ব্রংকিওলাইটিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে যা থেকে একে সহজেই নিউমোনিয়া থেকে পার্থক্য করা যায়। ব্রংকিওলাইটিসে কাশি, শ্বাসকষ্ট প্রধান উপসর্গ হলেও, জ্বর থাকে না বা কম থাকে। ব্রংকিওলাইটিস হলে শিশু ঠান্ডা-কাশি আর শ্বাসকষ্টে ভুগলেও সেই অর্থে অসুস্থ মনে হয় না অর্থাৎ শিশু হাসি খুশি থাকে। অপর দিকে নিউমোনিয়া হলে শিশু অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে, শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে, পাশাপাশি কাশি ও শ্বাসকষ্টের পরিমাণও বেশি থাকে।

ব্রংকিওলাইটিস রোগ নির্ণয় ও ঝুঁকি

তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা লাগে না। তবে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এর প্রধান চিকিৎসা অক্সিজেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের জটিলতা হতে পারে। যেমন- যাদের বয়স ৩ মাসের কম, অপরিণত বা প্রিম্যাচিওর বেবি, কম ওজনের নবজাগক এবং যেসব শিশুর জন্মগত হৃদপিণ্ডের ত্রুটি আছে। এটি ছোঁয়াচে রোগ, শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে রোগ জীবাণু ছড়ায়। তাই আক্রান্ত শিশু থেকে অন্য শিশুদের আলাদা রাখা উচিত। শিশুকে ধরা বা কোলে নেওয়ার আগে যে কারো ভালো করে হাত ধুয়ে নেওয়া জরুরি।

ব্রংকিওলাইটিসের চিকিৎসা

যে কোনো ব্রঙ্কোডাইলেটর, হাইপারটোনিক স্যালাইন এবং অক্সিজেন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করতে হয়। অনেক সময়, গ্লুকোকোর্টিকয়েড স্টেরয়েড প্রয়োজন হয়। অ্যান্টিবায়োটিক দরকার পরে না।

* নাক-গলা পরিষ্কার রাখুন, (বাল্বসাকার বাল্ব সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে পারেন)।

* জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে।

* বুকের দুধ, পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।

* শ্বাসকষ্টের জন্য নেবুলাইজার (ইপ্রাটোপিয়াম, সালবুটালিন) অথবা ব্রঙ্কোডাইলেটর সিরাপ (ব্রংকোলাক্স বা সালমলিন সিরাপ) খাওয়ানো দরকার পরে।

প্রতিরোধ ও সতর্কতা

* শিশুকে স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা যাবে না। উষ্ণ আবহাওয়ায় স্বাভাবিক আলো-বাতাস চলাচল করে এমন ঘরে রাখতে হবে।

* শীতের তীব্রতা অনুযায়ী হালকা ও নরম কাপড় পরিধান করাতে হবে।

* ধুলা-বালি, ধোঁয়া থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে, বড়দের শিশুর ঘরে বা সামনে ধুমপান করা যাবে না।

* সন্তানকে অন্যান্য অসুস্থ শিশু থেকে দূরে রাখতে হবে।

জেনে রাখবেন

বাচ্চার বয়স যদি তিন মাসের কম হয়, বাচ্চা যদি খাওয়া একেবারে ছেড়ে দেয়, কিংবা শ্বাস নেওয়ার গতি ২ মাসের কম বয়সি শিশুর মিনিটে ৬০ বার, ২ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত প্রতি মিনিটে ৫০ বারের বেশি এবং ১ থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুর মিনিটে ৪০ বারের বেশি হলে, শ্বাস নেওয়ার সময় বুকের পাঁজর দেবে গেলে কিংবা বাচ্চার ঠোঁট, জিহ্বা নীল হয়ে গেলে জরুরিভাবে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কারণ এসবই মারাত্মক নিউমোনিয়া বা মারাত্মক রোগের লক্ষণ।

লেখক : শিশুরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সাত মসজিদ রোড ধানমন্ডি, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *