শিশুর ইমিউনিটি বাড়াতে করণীয়
করোনাকালে দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি স্কুল খোলায় শিশুরা নতুন উদ্যমে আবারও ক্লাস করছে। তাদের মনে করোনা সংক্রান্ত ভয়ভীতি তেমন না থাকলেও পিতামাতারা বেশ উৎকণ্ঠায় আছেন, কারণ এখনো পর্যন্ত শিশুদের জন্য কোভিড টিকার অনুমোদন নেই।
গবেষকদের মতে, টিকা গ্রহণই হলো কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার সর্বোত্তম উপায়। যেহেতু শিশুদেরকে টিকা দেওয়া হচ্ছে না, তাই এমতাবস্থায় পিতামাতারা শিশুদেরকে করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে তাদের ইমিউনিটি (রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা) বাড়ানোর চিন্তা করছেন। শিশু বিশেষজ্ঞদের কাছে অনেকেই বাচ্চাদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করা বা ইমিউনিটি বাড়ানোর উপায় সম্পর্কে জানতে চান।
* স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ান
শিশুকে সুস্থ রাখার খাদ্যতালিকায় প্রচুর ফল ও শাকসবজি, গোটা শস্য এবং চর্বিহীন মাংস থাকবে। দিনে পাঁচবার ফল ও শাকসবজি খাওয়াতে পারলে ভালো। প্রতিবেলায় প্লেটের অর্ধেক যেন শাকসবজিতে ভরা থাকে। যেসব ফলে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন সি রয়েছে সেগুলোকে প্রাধান্য দিন। গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন সি শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর। চর্বিহীন মাংসের প্রোটিন শিশুকে সবল করবে, অন্যদিকে এতে বিদ্যমান জিংক সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শ্বেত রক্তকণিকাকে সাহায্য করবে।
বাচ্চাকে শুধু পুষ্টিকর/স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ালে হবে না। অস্বাস্থ্যকর খাবার থেকেও দূরে রাখতে হবে। তাকে প্রক্রিয়াজাত খাবার, চিনিযুক্ত খাবার ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটের মতো অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়াবেন না। উদাহরণস্বরূপ, কুকিজ ও আইসক্রিম পরিহার করা উচিত। এমন না যে এসব খাবার কখনও খাওয়ানো যাবে না, তবে শিশুকে সুস্থ রাখতে প্রতিদিন বা বেশি পরিমাণে খাওয়ানো উচিত নয়।
মেডিসিন শপে শিশুর ইমিউনিটি বৃদ্ধির সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়। এসবে আস্থা রাখার প্রয়োজন নেই। এসব সাপ্লিমেন্টের কোনোটাই স্বাস্থ্যকর খাবারের বিকল্প হতে পারে না। শিশুর পুষ্টির জন্য খাবারের বিকল্প খাবার হওয়াই উত্তম। তবে যেসব শিশু শাকসবজি একেবারেই খেতে চায় না বা যথেষ্ট খাবার খেতে পারে না, তাদেরকে আয়রন আছে এমন মাল্টিভিটামিন সেবন করানো যেতে পারে। আপনার বাচ্চার জন্য কোন ভিটামিন বা সাপ্লিমেন্ট উপযুক্ত তা জানতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারেন।
শরীরকে সতেজ ও সবল করতে আমাদের সকলেরই যথেষ্ট ঘুমের প্রয়োজন আছে। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। শিশুদের বয়সভেদে ঘুমের প্রয়োজন ভিন্ন হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা জানান, যাদের বয়স ৬ থেকে ১২ বছর তাদের জন্য ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর তারা ৮-৯ ঘণ্টা ঘুমালেই যথেষ্ট। কিছু শিশুর ক্ষেত্রে সময়ের পরিসর কমবেশি হতে পারে। এখনকার শহুরে পরিবারে বাচ্চারা স্মার্টফোন বা অন্যান্য ডিভাইসে বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু বিছানায় যাওয়ার আগপর্যন্ত এসব স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে ঘুমের মান কমে যায়। তাই স্ক্রিনের ব্যবহার সীমিত করতে হবে, বিছানায় যাওয়ার দেড়-দুই ঘণ্টা পূর্বে এসবের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।শিশুরা রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়লে সকাল সকাল জেগে ওঠতে পারবে ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম ও জাগরণ নিশ্চিত করতে হবে।ব র্তমান যুগের শিশুদের মেজাজ খিটখিটে হওয়ার কিছু কারণ স্পষ্ট, যার একটি হলো ঘুমের ঘাটতি। পর্যাপ্ত ঘুমালে বাচ্চার মন ও শরীর উভয়েরই উপকার হবে।
* সক্রিয় করুন
অনেক অভিভাবক এমন প্রকৃতির যে, বাচ্চাদের শরীরে ফুলের টোকা পড়লেও আঁতকে ওঠেন। এসব পিতামাতারা বাচ্চাদেরকে একেবারে নিষ্ক্রিয় রেখেই বড় করতে চান। তারা এটাকেই কল্যাণকর মনে করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুকে সক্রিয় রাখাতেই যত উপকার। সক্রিয়তায় শিশুর সুস্থতা বজায় থাকে ও সংক্রমণের ঝুঁকি কমে। শিশুকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা সক্রিয় রাখতে হবে। সক্রিয়তার মানে শুধু এটা নয় যে জিমে যেতে হবে। বাচ্চাদেরকে জিমে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার শিশুকে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে দিন। তারা মাঠে বা আঙিনায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করুক, বাধা দেবেন না।বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে আশপাশে হেঁটে আসতে পারেন। এমনও কিছু শিশু আছে, যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দৌঁড়ের ওপর থাকে। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। এতে তাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদেরকে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অতি নিষ্ক্রিয়তা বা অতি সক্রিয়তা- কোনোটাই শিশুদের জন্য ভালো নয়।
* মানসিক চাপ কমান
বাচ্চাদেরকে মানসিক চাপে রাখবেন না। মানসিক চাপে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও সংক্রমণের প্রবণতা বেড়ে যায়। শিশুদেরকে খেলার সময় খেলতে দিতে হবে। অন্য শিশুরা যখন খেলে, তখন আপনার বাচ্চাকে ঘরে আবদ্ধ রাখলে তার মানসিক চাপ বাড়বে। একসময় মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। একটা শিশু সমবয়সীদের সঙ্গে সময় কাটালে মন প্রফুল্ল হবে ও বুদ্ধিমত্তা বাড়বে। যেসব শিশু হাসিখুশিতে থাকে তাদের মধ্যে সংক্রমণের হার কম। পরিবারের বিরূপ আচরণে শিশুর মানসিক চাপ বাড়ে। তাই তাকে সহাস্য রাখতে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। তাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তাকে নিয়ে সহজসাধ্য বা সৃজনশীল কাজ করতে পারেন, যেমন- বাগান করতে পারেন। অবসর পেলে কোথাও ঘুরে আসতে পারেন। তাকে গল্পের বই দিতে পারেন। শিশু বয়সে গল্প পড়লে মানসিক চাপ কমার পাশাপাশি চিন্তাশক্তি বাড়ে। এছাড়াও যা করলে বাচ্চার মন ভালো থাকে তা করতে পারেন। তার যৌক্তিক আবদারও মেটাতে পারেন।
তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল