শিশুদের যেভাবে লালনপালন করতে বলেছেন রাসুল (সা.)
শিশুরা জান্নাতের ফুল। শুচি-শুভ্র নির্মলতা নিয়ে ধূলির ধরায় তাদের আগমন ঘটে। জান্নাতি পবিত্রতা থেকে পৃথিবীর পঙ্কিলতায় তারা যেন এভাবে ভূমিষ্ঠ হয়, কলির ভেতরের আবরণযুক্ত ও জীবাণুমুক্ত (Sterilizing) পরিবেশ থেকে ফুল যেভাবে পৃথিবীর দূষিত আবহাওয়ায় প্রস্ফুটিত হয়।
এ মর্মেই নবীজি (সা.) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে ইরশাদ করেছেন— প্রত্যেক নবজাতক ফিতরাত তথা ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে। এর পর তার মাতাপিতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান অথবা অগ্নি উপাসকরূপে রূপান্তরিত করে। যেমন চতুষ্পদ জন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে (জন্মগত) কানকাটা দেখেছ? (বুখারি, হাদিস নং-১৩৮৫)
এ কারণেই নবজাতক শিশু জন্মগ্রহণ করার পর আমাদের কিছু করণীয় থাকে। তাদের পৃথিবীর জীবনটাকে সুন্দর ও পরিপাটি করতে যেগুলোর ভূমিকা থাকে অপরিসীম।
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর করণীয়
নবজাতক শিশু ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক— ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম কাজ হলো তার ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত দেওয়া।
হজরত আবু রাফে (রা.) বর্ণনা করেন, ‘ফাতেমার ঘরে হাসান ইবনে আলি ভূমিষ্ঠ হলে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার কানে আজান দিতে দেখেছি।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
খ. সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রথম দিন বা সপ্তম দিন নবজাতকের নাম রাখা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আজ রাতে আমার একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে, আমার পিতা ইবরাহিমের নামানুসারে আমি তার নামকরণ করেছি ইবরাহিম।’ (মুসলিম শরফ)
অপর হাদিসে এসেছে— নবজাতকের সুন্দর নাম রাখা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের নিজ নামে ও তোমাদের বাপ-দাদার নামে আহ্বান করা হবে। অতএব তোমরা তোমাদের (সন্তানদের) নাম সুন্দর করে নাও।
গ. নবজাতকের বয়স সাত দিন হলে আকিকা দেওয়া। হজরত সামুরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন— প্রত্যেক সন্তান তার আকিকার বিনিময়ে বন্ধক হিসেবে রক্ষিত। অতএব সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে আকিকা কর, তার চুল কাট ও তার নাম রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি)
যদি কেউ সাত দিন পর আকিকা দিতে না পারে, তবে সে ১৪ কিংবা ২১ দিন পর আকিকা করবে। যদি তাতেও সমর্থ না হয়, তবে পরে তা আদায় করে নেবে।
ঘ. নবজাতকের জন্মের সপ্তম দিন মাথা মুণ্ডন করে চুলের ওজন পরিমাণ রূপা বা তার সমমূল্য দান করা। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন— রাসুলুল্লাহ (সা.) সপ্তম দিন হাসান ও হুসাইনের চুল কাটার নির্দেশ দেন এবং চুলের ওজন পরিমাণ রূপা সদকা করেন।(তিরমিজি শরিফ)
হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) হাসানের পক্ষ থেকে একটি বকরি আকিকা দিয়েছেন এবং বলেছেন— হে ফাতিমা, তার মাথা মুণ্ডন কর ও তার চুলের ওজন পরিমাণ রৌপ্য সদকা কর।’ (তিরমিজি শরিফ)
ঙ. নবজাতকের মাথা মুণ্ডনের পর মাথায় জাফরান লাগানোও সুন্নত। (আবু দাউদ শরিফ)
চ. তাহনিক করা। অর্থাৎ নবজাতকের মুখে খেঁজুর চিবিয়ে দেওয়া। ইমাম নববি বলেন, সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে খেজুর দিয়ে তাহনিক করা সুন্নত।
হজরত আনাস (রা.) বলেন আব্দুল্লাহ ইবনে আবু তালহা ভূমিষ্ঠ হলে আমি তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম, তিনি বললেন— তোমার সঙ্গে কি খেজুর আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেজুর চিবালেন, অতঃপর তা বের করে বাচ্চার মুখে দিলেন। বাচ্চাটি জিহ্বা দিয়ে চুষে চুষে ও ঠোঁটে লেগে থাকা অংশ চেটে খেতে লাগল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দৃশ্য দেখে বললেন— দেখ, আনসারদের খেজুর কত প্রিয়!।’ (মুসলিম শরিফ)
ছ. শিশুর বয়স সাত বছর হলে তাকে নামাজ এবং দ্বীনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেওয়া। শিশুর বয়স ১০ বছর হয়ে গেলে শাসন করে হলেও তাকে নামাজে অভ্যস্ত করা জরুরি। (মেশকাত শরিফ)।
পৃথিবী এখন প্রযুক্তির উৎকর্ষে অবস্থান করছে। যন্ত্রের ছোঁয়া লেগেছে আমাদের আচার-আচরণেও। শিশুদের যত্ন নেওয়া এমনকি তাদের শিক্ষাও এখন প্রযুক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
কিন্তু প্রয়োজনের বাইরে বিনোদনের জন্যও আমরা শিশুদের হাতে প্রযুক্তির বিষাক্ত উপকরণগুলো তুলে দিই। কখনও কখনও শুধু কান্না থামানোর জন্যও তাদের হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ অবাধে ছেড়ে দিই— এটি অন্যায়।
আপনার শিশুকে নিরাপদ শিক্ষা দিতে চাইলে আপনাকেই শিক্ষক হতে হবে। মা-বাবার কোল শিশুদের সুরক্ষিত বিদ্যালয়। নিজের সময় বাঁচাতে গিয়ে শিশুদেরকে ক্ষতির সম্মুখীন করা বুদ্ধিমানী নয়।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এপিজে আব্দুল কালাম সুন্দর বলেছেন, ‘আমরা আজকের দিনটি উৎসর্গ করি যেন আমাদের শিশুরা একটি সুন্দর আগামী পেতে পারে’।
অতএব আসুন, নববী আদর্শের আলোকে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণে করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।