যে কারণে আরও নির্দিষ্ট হওয়া দরকার করোনা আক্রান্ত শিশুদের বয়স বিভাজন
করোনাভাইরাস যখন ছড়িয়ে পড়ছিল তখন আতঙ্কের মধ্যেও অনেকের কাছে স্বস্তির বিষয় ছিল, ভাইরাসটি শিশুদের আক্রান্ত করছে না। অতি বৃদ্ধ বয়সীরাই কেবল এর শিকার হতে পারেন—পরিবারগুলোতে আতঙ্ক ছিল এরকম। বেশি সুরক্ষার চাদরে রাখার চেষ্টা হচ্ছিল পরিবারের মুরব্বিদের। কিন্তু, এপিসেন্টার যতবার বদলেছে এই ভাইরাস, তার চরিত্রও বদলে ফেলেছে। এবং গত ২২ এপ্রিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে একটি সাড়ে ৫ বছরের শিশু করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে নিশ্চিত হওয়ার পরে তার সংস্পর্শে আসা অনেকের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আর ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে একজন শিশু এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলো।
চিকিৎসক, শিশু অধিকার কর্মী ও শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, সময় এসেছে শিশুদের সুরক্ষা প্রশ্নটি নিয়ে এখন জোরেশোরে আলাপ তোলার। সবার আগে শুরু হোক বয়স নিয়ে কাজ। আক্রান্তের খবর প্রচারের সময় ১ থেকে ১০ বছরের শিশুদের একটি ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। তারা বলছেন, সেটি না করে দশ বছর পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে হবে। সাধারণত শূন্য থেকে এক বছর, এক বছরের পর থেকে ৫ বছর, ৫ বছরের পর থেকে ১০ বা ১২ বছর- এই তিনটি বয়সের শিশুদের মানসিক বিকাশ, ভাবনা, চাহিদা বিচিত্র ধরনের হয়। এক ধরনের বৈশিষ্ট্য দিয়ে আরেকজনের শারীরিক মানসিক চাহিদা নিরূপণ করা যায় না। ফলে এই শিশুদের যথাযথ বয়সের তথ্য দিলে তাদের আক্রান্তের ধরন এবং কারণ নিয়ে গবেষণা ও সুরক্ষার উপায়গুলো বের করা তুলনামূলক সহজ হতে পারে। চাইলে ১ মাস থেকে ৬ বয়সী শিশুদের মধ্যেও দুটি ভাগ করে ইনফ্যান্ট ও প্রাক শৈশব এমন বিভাজন করা যেতে পারে।
দেশের গত ১৫ দিনে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। ক্রমশ পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা নবজাতক বা শিশুদের নিয়ে। তাদের সঙ্গে প্রাক শৈশব বয়সী (৬ থেকে ১২) শিশুদের চাহিদা বা সুরক্ষা বলয় ভাবনা মিলবে না।
শিশুরা সবচেয়ে ডাইভারস গ্রুপ উল্লেখ করে শিশু অধিকারকর্মী ও সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, মায়ের বুকের দুধ খাওয়া শিশু আর তোলা খাবারে নির্ভর শিশুর বয়সের ফারাক দু’-এক বছরের কিন্তু তাদের লালন পালন, দেখাশোনা সবই আলাদা। ঠিক একইভাবে তাদের ওষুধের মাত্রা শুশ্রূষার ধরণও আলাদা হবে। ছোঁয়াচে রোগ বিস্তারের ক্ষেত্রে বয়সভিত্তিক ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক। যে হামাগুড়ি দিচ্ছে, যে কোলে আছে, যে দৌড় দিয়ে এ-ঘর ও-ঘর করছে কিংবা স্কুলে যায় বা যাবে অথবা কিশোর, যাকে এই লকডাউনের মধ্যেও পাড়ার দোকানে পাঠাচ্ছেন, তার চাহিদা ভিন্ন, দূষণের সম্ভাবনা এবং মাত্রাও ভিন্ন হবে। ফলে কে কোনভাবে আক্রান্ত হচ্ছে সেটা এই বড় পরিসরে শ্রেণিভেদ করা সম্ভব না। তারপর আছে তার জেন্ডার। আছে তার পরিবেশ। সে বস্তির খোলা পরিবেশে নাকি ইমারতের বদ্ধ পরিবেশে বড় হচ্ছে, গ্রামের নাকি শহরের। বয়সভিত্তিক তথ্যের সঙ্গে এসব তথ্যও বড় প্রয়োজন। এসব তথ্য যেমন প্রয়োজন সুরক্ষা দেওয়া পরিবারের জন্য, তেমনই দরকার চিকিৎসার মাপ নির্ধারণে হাসপাতালের জন্য। আবার তেমনই দরকার এই তথ্য নিয়ে গবেষণার জন্যও।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ গ্রিনলাইফ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান রাকিবুল ইসলাম মনে করেন, শিশুদের বয়সভিত্তিক এই বিভাজনটা যদি একটু সুস্পষ্ট করা যায় তাহলে খুব ভালো হয়। কিন্তু, আন্তর্জাতিকভাবে এবার একেক দশক ধরে ধরে তালিকা করতে দেখা যাচ্ছে। এক থেকে ১০ বছরের শিশু, ১১ থেকে ২০ বছরের শিশু এভাবে আলাদা করা হয়েছে। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে ৫ বছর পর্যন্ত শিশুদের আলাদা ধরি আমরা। সেই হিসেবে আলাদা ক্যাটাগরি করতে পারলে ভালো।
সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার বিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত সবাই শিশু। বড় দাগে এটা আলাদা করলেই শিশুদের আলাদা করা হয়। কিন্তু এটা যেহেতু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত, এর সঙ্গে চিকিৎসাসহ অনেক বিষয় জড়িত। এখানে ঢালাওভাবে না করে ভিন্নভাবে ক্যাটাগরি করার সুযোগ আছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ওষুধ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বয়সভিত্তিক আলাদা ক্যাটাগরি আছে। যেহেতু করোনা আক্রান্তের বিষয়টাও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত। এই শিশুদের ওষুধ, খাদ্যাভাস, মানসিক অবস্থা পৃথক পৃথক। কাজেই এভাবে ১ থেকে ১০ এবং ১০ থেকে ২০ যথাযথ পদ্ধতি হবে না। শূন্য থেকে ১ মাস বয়সের নবজাতক, ১ মাস থেকে ২ বছর বয়সের ইনফ্যান্ট, ২ বছর থেকে ৬ বছর পর্যন্ত প্রাকশৈশব, ৬ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত শৈশব, ১২ থেকে ১৮ পর্যন্ত কৈশোর। এই ৫টা ক্যাটাগরিতে শিশু তথ্য নেওয়া উচিত। এতে তাদের চাহিদা ভিন্ন, চিকিৎসা ভিন্ন, মানসিক অবস্থান ভিন্ন সেটি ফুটে উঠবে। যেহেতু করোনাভাইরাসের যাবতীয় ক্ষেত্রে আমরা ডব্লিউএইচও’র বৈশ্বিক গাইডলাইন মেনে চলছি, সেহেতু বয়সের ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে আমরা সেটা করতে পারি।
কেন জরুরি উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা একবার যদি তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ফেলি, পরে আলাদা করা সমস্যা হবে। ফলে শুরু থেকে পদ্ধতিগতভাবে শুদ্ধভাবে কাজটি করার জন্যই আমাদের এই আহ্বান।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অবশ্যই শিশুদের বয়সের বিশ্লেষণটি আরও স্পেসিফিক হওয়া উচিত। কারণ, প্রতিটি বয়সের শিশুদের একেক রকম চাহিদা এবং খাদ্যাভাস থাকে, তাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেমও একেক রকম। তাদের বিষয়ে আরও সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ করতে হবে। এর গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।