মৃত্যুর পর ফোন আসে শিশু আহনাফের, আবৃত্তিতে সে প্রথম হয়েছে
বাংলা ও ইংরেজি দুই বিভাগেই কবিতা আবৃত্তিতে প্রথম হয়েছিল শিশু আহনাফ তাহমিদ। তবে আহনাফের মৃত্যুর এক দিন পর স্কুল কর্তৃপক্ষের ফোনে আনন্দের এ খবর জানতে পারেন তার শোকার্ত বাবা।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খতনা করার সময় চিকিৎসকের অবহেলায় আহনাফ তাহমিদের (১০) মৃত্যু হয়। সে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত।
পুলিশ ও আহনাফের পরিবার বলেছে, অবেদনবিদ মাহবুব মোর্শেদ অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর শিশুটির আর চেতনা ফেরেনি। এ ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে মাহবুব মোর্শেদ ও জেএস ডায়াগনস্টিকের পরিচালক এস এম মোক্তাদির হোসেন এখন কারাগারে। কিন্তু মূল চিকিৎসক ইশতিয়াক রেজাকে এক মাসেও গ্রেপ্তার করা যায়নি।
আহনাফের বাবা ফখরুল আলম আবাসন ব৵বসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। আজ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকের অবহেলায় নয়, খতনা করার সময় চিকিৎসকেরা তাহমিদকে হত্যা করেছেন।’ তিনি এ বিষয়ে হত্যা মামলা করতে চান। এ নিয়ে হাতিরঝিল থানার ওসির সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান তিনি।
ফখরুল আলম বলেন, তিনি ছেলের মৃত্যুতে কোনো ক্ষতিপূরণ নয়, দ্রুত বিচার চান। তিনি বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, লোকাল ইনজেকশন দিয়ে যেন ছেলের খতনা করানো হয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর তাহমিদকে উচ্চ ক্ষমতার ইনজেকশন প্রয়োগ করেন। এতেই তাহমিদের মৃত্যু হয়।’ ফখরুল আরও বলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, অপচিকিৎসার কারণে এর আগে জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক মোক্তাদিরকে দুটি হাসপাতাল থেকে বহিষ্কার করেছে। আর মাহবুব কোনো অবেদনবিদ নন।
ছেলের জন্য মায়ের কান্না থামানো যাচ্ছে না বলে জানান ফখরুল আলম। বলেন, তিনি সারাক্ষণই ছেলের বিভিন্ন স্মৃতি নিয়ে আহাজারি করেন। ছেলের ‘হত্যার’ বিচার পাবেন কি না, তা নিয়েও সন্দিহান তিনি। কারণ, তাঁর নিয়োগ করা আইনজীবী সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান না।
তদন্ত কর্মকর্তা যা বললেন
এদিকে খতনা করার সময় যিনি মূল চিকিৎসক ছিলেন, সেই ইশতিয়াক রেজাকে এক মাস পরও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার এসআই রুহুল আমিন আজ প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পর ইশতিয়াক পালিয়ে গেছেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ইশতিয়াককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাময়িক বরখাস্ত করেছে। তবে আহনাফের মৃত্যুর কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার দুই চিকিৎসককে কেরানীগঞ্জের কারা ফটকে দুদিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন জেএস ডায়াগনস্টিকের পরিচালক মোক্তাদির ও অবেদনবিদ মাহবুব।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ওই দুজন জানিয়েছেন, আহনাফের মা-বাবার অনুমতি ছাড়াই অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। শিশুটিকে বাঁচাতে না পেরে তাঁরা অনুতপ্ত। শুরুতে শিশুটি ভয় না পেলেও অস্ত্রোপচার কক্ষে নেওয়ার পর কান্নাকাটি শুরু করে। এরপর অ্যানেসথেসিয়া দিয়েছিলেন তাঁরা। এরপরও তাকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। তখন আরেকটি ওষুধ দেওয়া হয়।
এসআই রুহুল আমিন জানান, অস্ত্রোপচারের সময় তিনজন চিকিৎসক ছিলেন। মূল অস্ত্রোপচারের কাজটি করেন ইশতিয়াক রেজা। গ্রেপ্তার দুই চিকিৎসক দাবি করেছেন, ইশতিয়াক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। অস্ত্রোপচার শুরুর কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বমি করে আহনাফ। বমি ফুসফুসে চলে যায়। তখন সে চিৎকার শুরু করে। কোনোভাবে থামানো যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় তাকে রেখেই ইশতিয়াক অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে পালান।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেএস ডায়াগনস্টিকের মালিক সাব্বির আহমেদ চৌধুরীকে পুলিশ খুঁজছে।
গত বছর থেকে জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে ‘হাসপাতাল’সেবা দেওয়া শুরু হয়। তবে এখনো হাসপাতাল পরিচালনার কোনো লাইসেন্স তারা দেখাতে পারেনি। দুই চিকিৎসক তাঁদের বৈধ কোনো নথিপত্রও পুলিশকে দেখাতে পারেননি। এমনকি অ্যানেসথেসিয়ার অনুমোদন রয়েছে কি না, সে বিষয়েও কোনো কাগজপত্র নেই।
অনেক দিন ধরেই ওই প্রতিষ্ঠানে মাহবুব অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করে এলেও তাঁর বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) নিবন্ধন নেই। অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করতে হলে বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সদস্য হতে হয়। তবে মাহবুব এটির সদস্য নন। মাহবুব রাজশাহীর একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা করেছেন।
গ্রেপ্তার অপর চিকিৎসক মোক্তাদির গাজীপুরের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।