বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের কীভাবে শিক্ষা দিতে হবে

শিক্ষা প্রতিটি শিশুর জন্মগত মৌলিক অধিকার। জন্মপূর্ব সময়ে মায়ের অসতর্কতা বা জন্ম পরবর্তীতে কোনো কারণে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুতে পরিণত হতে পারে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু ব্যাপক অর্থ নির্দেশ করে। এসব শিশুর গড় মান সাধারণ শিশুদের চেয়ে কখনো কখনো বেশি হয়, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কমও হয়ে থাকে।

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বলতে সেই সব শিশুদের বুঝায়, সমবয়স্কদের তুলনায় যাদের বুদ্ধি সংবেদন, শারীরিক বৈশিষ্ট্য, ভাব বিনিময় ক্ষমতা ও সামাজিক দক্ষতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম বা বেশি হয়। এসব শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়।

সরকার সবার জন্য শিক্ষা বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর শিক্ষার জন্যও করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি নিশ্চিতকরণ ও পাঠদান করা হচ্ছে, দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন উপকরণ। যেমন- হুইল চেয়ার, চশমা, ক্র্যাচ, হেয়ারিং ডিভাইস। এতে শুধু একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাই পাচ্ছে না, বরং সামাজিক বৈষম্য হ্রাস পাচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে তাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, দূর হচ্ছে তাদের প্রতিবন্ধকতাও। তাদেরকে সঠিক শিক্ষা, যথাযথভাবে গড়ে তুলতে পারলে তারাও স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারবে।

আমরা বিভিন্ন ধরনের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু দেখতে পাই। যেমন, শারীরিক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, দৃষ্টিতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, বাক ও শ্রবণে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, বুদ্ধি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, মানসিক ও আবেগিক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, ধীর শিখনজনিত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, অটিজম/অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারজনিত, সেলিব্রাল-পালসিজনিত, ডাউন-সিনড্রোমজনিত ইত্যাদি।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুয়ায়ী, দেশে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে চারজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। এসব শিশু সাধারণ শিশুদের চেয়ে ব্যতিক্রম, একেবারেই পৃথক তাদের শিখন কৌশল। ফলে তাদের চাহিদাটা বোঝা এবং আচরণের অস্বাভাবিকতাগুলো দূর করে সাধারণ শিশুদের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশার চেষ্টা করানোটা বিশাল চ্যালেঞ্জের। প্রতিটি শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে এসব শিশুর প্ল্যাটফর্ম যেন শক্ত হয়। ওদের অধিকারগুলো যেন ওরা অর্জন করে নিতে পারে; সাধারণ শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে ও খেলতে পারে, স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে এমন পরিবেশ তৈরি করা। প্রতিটি বিশেষ শিশুকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রত্যেকের প্রতি শিক্ষকদের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে এবং খুব ধীরে ধীরে তাদের কোনও একটি বিষয় শেখাতে হবে।

আমরা জানি যে, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর কিছু কিছু অনেক দুষ্টু প্রকৃতির হয়ে থাকে। তারা শিক্ষণে মনোযোগ দেয় না। শিক্ষক যখন শেখাতে চান তখন খামখেয়ালী করে। শিখতে চায় না। ক্লাসরুমে কথা বলে। অন্যদের বকাঝকা করে। গালিও দিয়ে থাকে। বিশেষ শিশুদের মধ্যে অনেকে আবার আছে, যারা ভালো করে শিক্ষকের কথা শোনে। ঠিক মতো পড়ালেখা করে। ক্লাসরুমে শিক্ষককে সাহায্য করে। একজন শিক্ষক তখন ভালো শিশুটির বার বার দৃষ্টান্ত দিতে পারেন। ভালো শিশুটিকে পুরস্কার দিয়ে দুষ্টু শিশুটিকেও ভালো করা যেতে পারে। ভালো ব্যবহার, প্রশংসা বা পুরস্কার পাবার জন্য দুষ্টু শিশুটিও ভালো হয়ে যাবে।

শিশু হচ্ছে ছোট্ট ফুলগাছ, আর শিক্ষক হলো ফুল-বাগানের মালি। ভালোবাসা দিয়ে, স্নেহ দিয়ে, যত্ন দিয়ে ছোট্ট ফুল গাছে ফুল ফোটাতে পারলেই শিক্ষকজীবন ধন্য। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সমাজ থেকে আড়াল করে, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে সমাজ তথা দেশের কাক্সিক্ষত অগ্রগতি সম্ভব নয়।

শিক্ষককে হতে হবে মেধাবী, পেশাজীবী মনোভাবসম্পন্ন, শিক্ষার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। তাকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে, প্রতিটি শিশু সম্ভাবনাময় এবং প্রতিটি শিশুই অনন্য। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সহায়তাকল্পে একজন শিক্ষকের কিছু বিশেষ ভূমিকা থাকা আবশ্যক। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাদান কাজে নিয়োজিত একজন শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সব সময় ধৈর্য ধারণ করা এবং শিশুদের কথা বা তথ্যটি সম্পূর্ণভাবে বলার সুযোগ দেয়া; এতে তারা উৎসাহ পাবে ও যোগাযোগ করার প্রেরণা পাবে। এসব শিশুর পারিবারিক বিষয়ে বেশি করে খোঁজখবর নেয়া এতে অভিভাবকেরা শিক্ষকদের প্রতি আশ্বস্ত হন এবং শিশুদের জড়তা অনেকখানি দূরীভূত হয়। প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যাওয়া এবং আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান করা। শ্রেণিকক্ষে এক জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বা বসে না থাকা। শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে পাঠ-সংশ্লিষ্ট ছবি, সংকেত বা অন্যান্য উপকরণ লাগিয়ে রাখা, সম্ভব হলে সব পাঠ উপস্থাপনায় উপকরণ ব্যবহার করা। শিশুদের দিকে সরাসরি মুখ করে পাঠদান করা, শ্রেণিকক্ষে এমন স্থানে দাঁড়ানো যেন শ্রেণিকক্ষের সব শিক্ষার্থীই বাধাহীনভাবে দেখতে পায়।

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের প্রথম সারিতে বসানোর ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনবোধে এমন স্থানে বসানো যাতে শিক্ষক সহজেই তাদের কাছে যেতে পারেন। সরল-সহজবোধ্য-সাবলীল ভাষায় পাঠদান করা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যথাসম্ভব কথার পুনরাবৃত্তি করা, যাতে দৃষ্টি ও শ্রবণে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর বুঝতে কোন সমস্যা না হয়। পাঠের বিষয়গুলো যথাসম্ভব বোর্ডে লিখে পাঠদানের ব্যবস্থা করা। বোর্ডে লেখার সময় স্পষ্ট ও বড় করে লেখা; এতে কম দৃষ্টি সম্পন্ন শিশুদের দেখতে সুবিধা হয়। শিশুদের সব সময় উৎসাহিত করা; অপারগ শিক্ষার্থীদের কখনো তিরষ্কার না করা। প্রতিবন্ধিতার জন্য কাউকে উপহাস না করা; বরং প্রতিবন্ধীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা। অন্য সহপাঠীরা যেন তাদের বন্ধু মনে করে সেই জন্য সহপাঠীদের মোটিভেশন করা। শুধু পাঠ্য-বইয়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের আবদ্ধ না রেখে পাঠদান কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমও অধিক হারে চালিয়ে যাওয়া। শিক্ষার্থীদের কোনভাবেই শারীরিক ও মানসিক শাস্তি না দেয়া। শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে দলীয় কাজ প্রদান করা; পাঠদান শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক এবং কর্মভিত্তিক হতে হবে। পাঠদানের সময় যথাসম্ভব শারীরিক অঙ্গভঙ্গিও ব্যবহার করতে হবে। চলাচলে সমস্যাসম্পন্ন শিশু (হুইলচেয়ার, ক্র্যাচ ব্যবহারকারী) কোন শ্রেণিতে থাকলে সে শ্রেণিকে অবশ্যই নিচতলায় রাখার ব্যবস্থা করা। শ্রেণিকক্ষের ভেতরে চলাচলের জন্য যথাসম্ভব খালি জায়গা রাখতে হবে। সব সময় কৃতকার্যের জন্য বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে বেশি বেশি করে বাহবা দিতে হবে। অকৃতকার্যের জন্য তিরষ্কার করা যাবে না, বরং যথাসম্ভব বিষয়টি শিশুদের বুঝিয়ে দিতে হবে। অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা ও পরামর্শ প্রদান। নিয়মিত ও সময়মতো প্রতিবন্ধী শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে অভিভাবকদের উৎসাহিত করা। প্রয়োজনে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে অভিভাবককে অনুরোধ করা।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, শাঁকদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

One thought on “বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের কীভাবে শিক্ষা দিতে হবে

  • জুলাই ১০, ২০২৩ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    Good luck!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924