বিচ্ছেদের পর সন্তানের প্রতিপালন
বাংলাদেশে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সংখ্যক বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, গত ৭ বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে শিশুদের জীবন। সন্তান কার সঙ্গে থাকবে এ নিয়ে টানাহেঁচড়াও কম হয় না। এমনকি কখনো কখনো বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অথচ এ বিষয়ে ইসলামের নীতিমালা অনুসরণ করা হলে এ নিয়ে বিভেদ থাকার কথা নয়।
জন্মগতভাবে সন্তান বাবা-মা উভয়ের। বংশগত দিক দিয়ে সন্তান পিতার বলে গণ্য হয়ে থাকে। তবে সন্তানের প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ী তার দায়িত্বভার মা-বাবা উভয়ের ওপরই অর্পিত। কোনো কারণে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেলে তখন সন্তানের লালন-পালনবিষয়ক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে শরিয়তের দিকনির্দেশনা হলো শিশুসন্তানের লালন-পালনের অধিকার মায়ের।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, একদা এক নারী বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, এই সন্তান আমার গর্ভজাত, সে আমার স্তনের দুধ পান করেছে এবং আমার কোল তার আশ্রয়স্থল। তার বাবা আমাকে তালাক দিয়েছেন। এখন তিনি সন্তানটিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাচ্ছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, তুমি অন্যত্র বিয়ে না করা পর্যন্ত তুমিই তার (লালন-পালনের) অধিক হকদার। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২২৭৬)
মায়ের কাছে কতদিন থাকবে : শিশু যতদিন পর্যন্ত পানাহার, পোশাক পরিধান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলোতে মায়ের মুখাপেক্ষী থাকবে, ততদিন পর্যন্ত মা শিশুকে নিজ জিম্মায় রাখতে পারেন। এর সময়সীমা ছেলেশিশুর জন্য সাত বছর, আর মেয়ের ক্ষেত্রে সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত। ওই সময় শেষ হওয়ার আগে শরিয়ত সমর্থিত কোনো কারণ ছাড়া সন্তানকে তার মা থেকে পৃথক করা বৈধ নয়। ওই সময় পার হলে পিতা শিশুসন্তানকে মায়ের কাছ থেকে নিজ জিম্মায় নিয়ে আসতে পারে। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩/৫৬৬) আর সন্তান বড় হলে বিষয়টি তার ইচ্ছাধীন, যার সঙ্গে ইচ্ছা থাকতে পারবে।
ভরণপোষণ : সন্তানের যাবতীয় ভরণপোষণের ব্যাপারে নির্দেশনা হলো, সন্তান যার কাছেই প্রতিপালিত হোক না কেন, তার ভরণপোষণের ব্যয়ভার বাবার ওপরই ন্যস্ত থাকবে। তবে সন্তানের নিজস্ব সম্পত্তি থাকাবস্থায় তার সম্পদ থেকেও ব্যয় করা যাবে, যদি পিতার সামর্থ্য না থাকে। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩/৫৫৭)
মা কখন অধিকার হারাবেন : বেশ কয়েকটি কারণে মা সন্তানকে কাছে রাখার অধিকার হারাবেন।
এক. নীতিহীন-উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করলে এবং অসামাজিক কাজে জড়িত থাকলে। কারণ তার কাছে সন্তানের সুস্থ-স্বাভাবিক লালন-পালন সম্ভব হবে না।
দুই. এমন কারও সঙ্গে তার বিয়ে হলে, যিনি শিশুটির মাহরাম আত্মীয় নন। কেননা তখন স্বামীর বাড়িতে স্বামীর হক আদায় করতে গিয়ে শিশুর লালন-পালনে ব্যাঘাত হবে।
তিন. সন্তানের লালন-পালনে অবহেলা করলে বা বিশেষ কোনো কারণে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে।
চার. যদি সে ইসলাম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে তখনো সন্তানের ধর্মীয় মূল্যবোধ সুরক্ষার জন্য তাকে তার কাছে রাখা যাবে না।
পাঁচ. যদি মায়ের জিম্মায় থাকা অবস্থায় তিনি সন্তানের বাবাকে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে না দেন। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৪২)
তবে মা যদি তার নতুন সংসারে সন্তানের প্রতিপালন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে এবং মায়ের পরবর্তী স্বামী এ সন্তানের লালন-পালনে খুশি থাকে, সে ক্ষেত্রে মাকে সন্তানের জিম্মাদারি দিতে কোনো সমস্যা নেই। (ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া : ৪/৪২৫)
মায়ের অবর্তমানে : মায়ের অবর্তমানে শিশুর লালন-পালনের দায়িত্ব তার নিকটাত্মীয়দের ওপর বর্তাবে। এ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ক্রমধারা অবলম্বন করা হবে। মায়ের অবর্তমানে নাবালক শিশুর হেফাজতকারী পর্যায়ক্রমে হবেন নানি, দাদি আপন বোন, বৈপিত্রেয় বোন, আপন বোনের মেয়ে, বৈপিত্রেয় বোনের মেয়ে, আপন খালা, বৈপিত্রেয় খালা, আপন ফুফু প্রমুখ। উল্লেখ্য, আত্মীয়রা ক্রমানুসারে একজনের অবর্তমানে বা অযোগ্যতার কারণে অন্যজন জিম্মাদারিত্বের অধিকারী হবেন।
মা অথবা অন্য নারী আত্মীয়দের অবর্তমানে শিশুর জিম্মাদার হবেন পর্যায়ক্রমে বাবা, দাদা, সহোদর, রক্তের সম্পর্কের ভাই, আপন ভাতিজা, রক্তের সম্পর্কের ভাতিজা, চাচাত ভাই, বাবার রক্তের সম্পর্কের ভাতিজা প্রমুখ। স্মর্তব্য, একজন পুরুষ আত্মীয় একজন নাবালিকার জিম্মাদার শুধু তখনই হতে পারবেন, যখন তিনি ওই নাবালিকার মাহরাম (নিষিদ্ধ স্তরের) আত্মীয় হন। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৪, রদ্দুল মুহতার : ২/৬৩৮)
সন্তানের সাক্ষাৎ : সন্তান যার কাছেই প্রতিপালিত হোক, মা-বাবার কোনো একজন যদি সন্তানকে দেখতে চান অথবা সন্তান মা-বাবাকে দেখতে চায়, তাহলে অবশ্যই সাক্ষাতের সুযোগ দিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৬৪৩) এ বিষয়ে আরব-অনারবের সব আলেম একমত। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে তা জুলুম ও অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে।