বাড়ছে শিশুশ্রম, বঞ্চিত হচ্ছে শিশু অধিকার
জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে। অনেক চড়াই-উৎরাই সত্ত্বেও এ দেশটি যেন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতিতে অনেকাংশেই এগিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র অনেকটাই আশাব্যঞ্জক। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশ আজ নানাভাবে সুপরিচিত। ইতোমধ্যে এ দেশটি ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ এর তকমা গায়ে লাগালেও মূলত: মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। অদৃশ্য কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের বাজারমূল্য মোটেই নিয়ন্ত্রণে নেই। এমতাবস্থায় শিশুসহ পুরো জনগোষ্ঠী চরম ভোগান্তির শিকার। এ মুহুর্তে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা কেমন আছে? কোথায় আছে? সীমিত সম্পদ আর সীমাহীন দুর্ভোগকে সঙ্গী করে অনেক শিশু অবেলায় তাঁদের শিক্ষাজীবনের ইতি টেনেছে।
ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর তথ্যমতে, করোনা পরবর্তী পুরো দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শিক্ষাজীবন অনেকটাই ঝুঁকির মুখে। আজকাল আর স্কুলের সঙ্গে তাঁদের কোন যোগাযোগ নেই। ছোট্ট বাড়িতে বা বস্তি এলাকায় কেমন কাটতে পারে তাঁদের দৈনন্দিন? ইতোমধ্যে মা-বাবার প্রাত্যহিক কাজের সহযোগী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করলেও, আজ তাঁরা নতুন করে উপার্জনকারী ‘শ্রমিক’ হিসেবে প্রমাণ করছে। আজকাল নতুন করে গৃহকর্মে, ইটের ভাটায়, কলকারখানায়, হোটেলে, ভ্যানে, এমনকি মাদক-জুয়ার আসরেও তাঁদের শ্রম বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। অথচ, আইনের এই বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করে অনিয়মতান্ত্রিক শিশুশ্রম চলছে দেশের আনাচে কানাচে সর্বত্রই। যা শিশু সুরক্ষা তথা শিশু অধিকারের পরিপন্থি। আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার আনন্দে পুলকিত; ঠিক সেই মুহুর্তে এসব শিশু তথা আগামীর ভবিষ্যতের ভয়াবহতার কথা ভাবলে কি আর ভালো থাকা যায়?
শৈশবে যার হাতে থাকার কথা ছিল বই, খাতা আর পেন্সিল, যাদের হাত ধরে এদেশ নতুন করে এগিয়ে যাবার কথা, তাঁরাই যেন আজ জীবিকায়নের মূল কারিগর হয়ে অভাবগ্রস্ত সংসারের সংগ্রামী সৈনিক সেজেছে। একশ্রেণীর লোভী, অর্থ-পিপাসু মানুষ নামের দানবেরা এই সকল শিশু ও তাঁর পরিবারের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে নামমাত্র পারিশ্রমিকে তাঁদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে। কেননা, শুধুমাত্র বয়সে কম অথবা শিশু হবার জন্যই তাঁদের শ্রমের মূল্য খুবই নগন্য হয় এ সমাজে।
সমগ্র পৃথিবী জুড়ে শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যপক কর্মসূচি গৃহীত হলেও শিশু নির্যাতন তথা শিশু অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি থেমে নেই একটি মুহুর্তের জন্যেও। চোখের সামনেই এমন অজস্র ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই। নির্বাক দর্শক-শ্রোতা হয়ে যেন কেবল হজম করে ফেলি সবকিছুই! আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিশু অধিকার সনদে মূলনীতি হিসেবে (১) বৈষম্যহীনতা, (২) শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা, (৩) শিশুর অধিকার সমুন্নত রাখতে অভিভাবকদের দায়িত্ব ও (৪) শিশুদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এর কথা উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশে এর যথাযথ প্রয়োগ খুবই বিরল। মজার ব্যাপার হলো, একই ছাদের নিচে বাড়িওয়ালার শিশু-সন্তানেরা যখন ঘুমকাতুরে হয়ে সকাল ১০টায় বিছানা ছেড়ে ওঠে, একই বয়সী গৃহকর্মী নামক আরেকটি শিশুকে তখন কাকভোরে উঠে রুটিন মাফিক ভারী কাজে মনোনিবেশ করতে হয়। নিয়মিত কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হলেও কোনদিন কোনো বাড়তি প্রশংসা না জোটে না। অথচ, একদিন ব্যতিক্রমী কিছু ঘটলেই পুরষ্কার হিসেবে জোটে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। আর এসবের সাক্ষী হয় তাঁদেরই সমবয়সী আলালের ঘরে দুলালেরা। তবে শিশু অধিকার সনদ কি কেবলই ওই অভিজাত শ্রেণির বিশেষ শিশুদের জন্যই? এই শিশু অধিকার সনদ কি তাহলে সার্বজনীন নয়?
শিশুশ্রম কেবল একটি শিশু বা তাঁর পরিবারকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে না বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলে তার সব সম্ভাবনা। নিষ্পাপ শিশুর শৈশবকে যারা গলা টিপে হত্যা করে বা যারা প্ররোচিত হতেও বাধ্য করে তাঁরা আসলে কেমন মানুষ। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হলো সু-শিক্ষা (প্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তবভিত্তিক)। তবে অনুকূল পরিবেশের অভাবে অন্য আরেকটি মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ অন্ন জোগাড় করতে তখন শৈশবেই তাকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় এ দেশে। কাজ যতই হোক পারিশ্রমিকের বেলায় (অল্প টাকায়) কেবলমাত্র শৈশবকে বিবেচনা করা হয় এ সমাজে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৮.৭-এ বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে হবে। আর এখনি তার প্রকৃত সময়। সাম্প্রতিক কোভিড পরিস্থিতি, সঠিক কর্মসংস্থানের অভাব ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে বাংলাদেশে নতুন করে দরিদ্রের হার বাড়ছে। এর ফলে শিশুশ্রমের ওপর এক ব্যপক প্রভাব পড়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রম নিয়োগ সম্পর্কে যে মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে মূলত চারটি মাত্রার কথা বলে হয়েছে: সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, যৌথ দর-কষাকষির অধিকার, শিশুশ্রমিকের অনস্তিত্ব ও বৈষম্যহীন নিয়োগ ব্যবস্থা। এগুলো নিশ্চয়ই সব দেশে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এর প্রয়োগকৌশল নিয়ে। দিন, মাস, বছর যায়। সময়ের পরিক্রমায় ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম দিবস, মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। অনেকে আমরা শিশুদের উন্নয়নে অনেক কাজ করি, গবেষণা চালিয়ে যাই। বড় বড় প্রকল্প হাতে নিই। অনেকে আবার দেশ বরেণ্য মানুষের স্বীকৃতি স্বরুপ নামী-দামী পুরষ্কারও পায়। তবে দু:খজনক হলেও সত্যি আমজনতার শিশুদের অধিকার কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয় না। বন্ধ হয় না শিশুশ্রম!
শিশুশ্রম ও শিশু অধিকারের বিষয়টি আমাদের মনে নিশ্চয়ই অনেক বেশি নাড়া দেয়। সত্যিই তাই! বাস্তবতা হলো: সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে শিশুশ্রম কমবে না, শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অনেক বড় ভূমিকা নিতে হবে। সুন্দর আগামীর জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি প্রয়োজন, প্রতিটি শিশুর জন্য আমজনতার আন্তরিক ভালোবাসা। নয়তো, এই শিশুরাই আগামীতে গর্বিত নাগরিক না হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তিসহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে যাবে! রাগ-ক্ষোভ-অভিমানে এদেশের মানচিত্রকেও হয়তো তাঁরা চিবিয়ে খেতে চাইবে একদিন!
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই যেখানে শিশু (ছয় কোটি ষাট লক্ষ), সেখানে শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করা কতটা জরুরি তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। এদেশে আগামী দিনের নির্মল সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার ক্ষেত্রে শিশুদের উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। শিশুদের সার্বিক উন্নয়নের পূর্বশর্তই হলো শিশু নির্যাতনমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এক্ষেত্রে সরকারি- বেসরকারি প্রতিটি দপ্তরে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। উপকারভোগী ও সেবাদানকারী উভয় পক্ষকে শিশু নিরাপত্তা, শিশু অধিকার ও সমন্বিত উন্নয়ন সম্পর্কে সংবেদনশীল হতে হবে। শিশুদের উন্নয়নের নেপথ্যে ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রায় গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ নিবিড় পরর্যবেক্ষনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।
সারা বিশ্বের ৮০টি দেশের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ১২ জুনে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হবে। সম্প্রতি বিগত বছরগুলোতে ১২জুনে ‘সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ কর‘, ‘গৃহকর্মে শিশুশ্রমকে না বলুন ’মুজিববর্ষের আহ্বান, শিশু শ্রমের অবসান`-এসব প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়:শিশুর শিক্ষা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ করি” অর্থাৎ শিশুদের উন্নয়নের স্বপক্ষেই যেন সকল আহ্বান! অথচ, অদৃশ্য কারণে আজো শিশুশ্রম এর ব্যপকতা যেন বাড়ছেই! শিশুশ্রম এর ভয়াল থাবা থেকে এদেশকে মুক্ত করতে না পারলে উন্নয়ন যাত্রা যেমন থমকে যাবে, ঠিক তেমনি পিছিয়ে পড়বে জাতি! তাই শিশুশ্রম বন্ধের সঠিক সময় এক্ষুণি।
যদিও বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী এদেশে ‘বাড়ছে শিশুশ্রম, বঞ্চিত হচ্ছে শিশু অধিকার’। তবুও যে কোনও সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই চাইবেন শিশুশ্রম বন্ধ হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক শিশু অধিকার। আমরাও প্রত্যাশায় আছি সেদিনের! হয়তো সেদিন সন্নিকটে।
লেখক: লেখক ও উন্নয়ন কর্মী