নানামুখী নির্যাতনে শারীরিক-মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত

আজ আন্তর্জাতিক শিশু দিবস। শিশু অধিকার সনদের আলোকে শিশুদের জন্য বিশ^ব্যাপী ইউনিসেফ দিবসটি পালন করে শিশুদের নিয়ে। ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর বিশ্বনেতারা শিশু অধিকার বিষয়ে ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’ বাস্তবায়ন করেন। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে অনুমোদিত মানবাধিকার চুক্তি। জাতিসংঘ শিশু অধিকার (সিআরসি) সনদে সাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। আরও গর্বের বিষয় এই যে, বাংলাদেশে এরও অনেক আগে, ১৯৭৪ সালে শিশু অধিকার আইন প্রণয়ন করেন জাতির পিতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শিশুর অধিকার সুরক্ষায়, মানসিক বিকাশে বর্তমান সরকারেরও রয়েছে নানাবিদ কর্মসূচি। এর পরও বর্তমানে নানামুখী নির্যাতনের শিকার শিশু-কিশোররা, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্তরায়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ২০টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার তথ্যানুসারে করা এক সমীক্ষায় জানাচ্ছে, বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও নারী ও কন্যার সংখ্যা বেশি। নারীদের তুলনায় কন্যারা ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে যথাক্রমে ১৮, ১১ ও ৩১ শতাংশ। উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ১ থেকে ১৩ বছরের শিশুর সংখ্যা ২২ শতাংশ। কন্যাশিশুর মধ্যে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বেশি। ধর্ষণের ক্ষেত্রে এ হার ৪৫ শতাংশ, দলবদ্ধ ধর্ষণের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ এবং উত্ত্যক্তের ক্ষেত্রে ৬৭ শতাংশ। সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিচিত মানুষ, বিশেষ করে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়।

নির্যাতনের শিকার হয় প্রতিবন্ধী শিশুও। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরের তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অটিজমে আক্রান্ত ৪৫টি শিশুর ওপর গবেষণা করে জানা গেছে, ৩ থেকে ৯ বছর বয়সী প্রত্যেক শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এসব শিশুর ৮ থেকে ৯ শতাংশ কোনো না কোনো সময়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গবেষকরা এসব শিশুর মায়েদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে অপর এক গবেষণায় তারা জানিয়েছেন, ২০২১ সালে শহর ও গ্রামের নবম ও দশম শ্রেণির ৪৫৬ জন শিক্ষার্থীর ওপর করা এক গবেষণায় জানা গেছে, ৫৬ শতাংশ কিশোর ও ৬৪ শতাংশ কিশোরী ইন্টারনেটের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গ্রামের চেয়ে শহরের কিশোর-কিশোরীরা দেড়গুণ বেশি নির্যাতনের শিকার। গবেষকরা বলছেন, যেসব কিশোর-কিশোরী ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক ও চ্যাটরুম নিয়মিত ব্যবহার করে, তাদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সমীক্ষা অনুসারে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে তরুণদের সম্পৃক্ততা বেশি। অভিযুক্তদের মধ্যে ২৬ শতাংশের বয়স ১১ থেকে ৩০ বছর। দলবদ্ধ ধর্ষণের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছর এবং উত্ত্যক্তের বেলায় ৮৫ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছর। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ নারীর প্রতি অধস্তন মনোভাব ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পত্রিকায় প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কন্যারা এবং নির্যাতনকারী বয়সে কিশোর ও তরুণ। নির্যাতিত শিশু ও নির্যাতনকারী শিশুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এটা খুবই আশঙ্কার বিষয়।

শিশুর অধিকার, সুরক্ষা ও তার বিকাশে সরকারের উদ্যোগগুলো যথেষ্ট কি না এবং সেসব প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি আছে কি না তা নিয়ে কথা হয় ওয়ার্ল্ড ভিশনের উপপরিচালক, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড জাস্টিস ফর চিলড্রেন নিশাত সুলতানার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আইন কাঠামোতে শিশু সুরক্ষার জন্য বিদ্যমান আছে নানা আইন ও নীতিমালা। যেমন জাতীয় শিশুনীতি-২০১১, শিশু আইন-২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন ও দমন আইন-২০০০, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি-২০১৫, শ্রম আইন- ২০০৬, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ ছাড়াও অনেক আইন। বাংলাদেশের শিশুদের জন্য অনেক নীতিমালা ও আইনের প্রচলন থাকলেও আইনের বাস্তবায়নে রয়েছে ঘাটতি। শিশু আইন-২০১৩ সালে প্রণীত হলেও এ পর্যন্ত আইনটির কোনো বিধিমালা আমরা পাইনি। ফলে আইনটি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা শিশুদের জন্য সর্বজনীন কিংবা অভিন্ন সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারিনি। একেক আইনে শিশুর সংজ্ঞা একেকভাবে নির্ধারিত হয়েছে। শিশুদের বয়স নিয়েও আছে বিভ্রান্তি। সংজ্ঞায়নের এই মারপ্যাঁচে খর্ব হচ্ছে শিশুর অধিকার। শিশুদের অধিকার সমন্বিত রাখতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর যে সমন্বয় প্রয়োজন ছিল, সেটি চোখে পড়ে না। আজ পর্যন্ত আমরা শিশুদের জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। অথচ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শিশু। শিশুর জন্য বার্ষিক যে বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে সেটি ঠিকমতো ব্যয় করা হচ্ছে কি না এর সুষ্ঠু মনিটরিং নেই। শিশু উন্নয়নে এসবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী, ‘১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924