দিনভর দিশেহারা শিশু করোনা রোগীর মা, গভীর রাতে ওষুধ নিয়ে এল অচেনা মানুষ

দেশের সবচেয়ে কম বয়সী করোনা পজিটিভ চন্দনাইশের ১০ মাস বয়সী শিশু আরিফ (ছদ্মনাম) গত ১০ দিন ধরে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে সয়ে চলেছে করোনার অসহনীয় যন্ত্রণা। করোনা পজিটিভ না হয়েও মায়ের চিরকালীন টানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে আরও ৩৯ করোনা রোগীর সাথে থাকছেন তার মাও। শহরে কোন স্বজন না থাকা এই নারী একলা তার শিশুকে নিয়ে এই শহরে পড়েছিলেন চরম ভোগান্তিতে। যে ভোগান্তিতে নিজ এলাকার কোনো রথি-মহারথিকে পাশে না পাওয়ার আক্ষেপ তাকে এখনও কষ্ট দিলেও ধন্যবাদ দিতে ভুলছেন না অপরিচিত সেই মানুষদের— যারা চরম দুর্দিনে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন।

গত ২১ এপ্রিল রাতে দেশের সবচেয়ে কম বয়সী শিশু আরিফের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয় চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষার ল্যাব ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডিতে। ওই সময় ছেলেকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল তার মা। পরদিন সকালে ছেলেসহ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় তাকে। সেখানে ডাক্তাররা জরুরি কিছু ওষুধ লিখে দিলেও শহরে কোন আত্মীয়স্বজন না থাকায় সেই ওষুধ সংগ্রহ করতে পারছিলেন না তিনি। ওয়ার্ডের দায়িত্বরত নার্স- ওয়ার্ডবয়দের অনুরোধ করলেও ‘ওয়ার্ড থেকে বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই’ জানিয়ে তারাও জানান অপারগতার কথা। সকালে লিখে দেওয়া ওষুধ সন্ধ্যা গড়িয়েও সংগ্রহ করতে না পেরে যখন তিনি পাগলপ্রায়, সে সময় ত্রাণকর্তা হয়ে এগিয়ে আসেন একই ওয়ার্ডে করোনা পজিটিভ হয়ে ভর্তি হওয়া আরেক নারী। তিনি আরিফের মাকে একজনের ফোন নম্বর দেন। ওই ফোনে যোগাযোগ করার পর রাত ২টার দিকে ওষুধ সংগ্রহ করে জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছে দেন অচেনা মানুষগুলো।

জেনারেল হাসপাতালে প্রথম দিনের সেই অসহায়ত্বের বর্ণনা দিয়ে শিশু আরিফের মা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি তো কিছু জানি না। আমি তো কোনদিন এই পরিস্থিতির শিকার হই নাই। যেদিন আমাকে জেনারেল হাসপাতালে আনা হইছিল আমি আমার বাচ্চার ওষুধটুকু আনতে পারতেছি না।’

তিনি বলেন, ‘আমার আত্মীয় স্বজন থাইকাও নাই। সবাই তো বাড়িতে লকডাউন হয়ে গেছে। ডাক্তার সকালে ওষুধ লেখে দিছে। কাউরে দিয়া আনাতে হবে। আমার তো এখানে কেউ নাই। ওদেরকে বলছি আমি টাকা দেব। আপনারা আমাকে একটু হেল্প করেন। ওরা বলতেছে আমাদের এটা নিয়ম নেই। আমরা বাইরে যেতে পারবো না।’ এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই মা।

‘আমি তো পাগলের মত হয়ে গেছি। সকালে ওষুধ লেখে দিছে। সারাদিনেও আমি ঔষধ আনাতে পারি নাই। পরে একটা মহিলা এখানে ভর্তি ছিল। তিনি আমাকে একটা নাম্বার দেন। আমি ওই নাম্বারে কল করছি…ওদেরকে অনেক ধন্যবাদ। ওরা আমাকে রাতের ২টা বাজে ওষুধ আইনা দিছে। আমি আমার বাচ্চাটাকে ওষুধ ঠিকমতো দিতে পারছি ওদের জন্য। ওনারাই সবকিছু করছে। অথচ ওনারা আমাকে চিনেন না। আমার এলাকারও না’— কিভাবে সমস্যার সমাধান হলো তা ব্যাখ্যা করে বলেন ওই মা।

‘কিন্তু আমার খারাপ লাগে। আমি চন্দনাইশের একটা নারী। আমার চন্দনাইশ থেকে কারো হেল্প পাই নাই। সব কিছু ওই ভাইয়া-আপুরা করছে। চন্দনাইশে এত মানুষ আছে, ওখানে তো অনেক বড় বড় নেতারা থাকে না? অনেক বড় বড় ইয়া থাকে না? আমাকে কেউ কোন হেল্প করে নাই’— চরম বিপদে নিজের এলাকার কারো কোন সহযোগিতা না পাওয়ার কথা জানিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি।

তবে ১০ দিন পর চন্দনাইশের একজন তাকে ফোন করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুক্রবার সকালে একজনে কল দিসে আমারে। আমি উনারে জিজ্ঞেস করছি আপনারা এতদিন কই ছিলেন? তিনি বলছেন আমরা তো কিছু জানিনা। আমি যে এখানে অসহায়ের মত পড়ে আছিলাম, সব মোবাইলে ইন্টারনেটে ছড়াই পরছে না? তারা কী বলে জানেন না!’

জেনারেল হাসপাতালে প্রথম কদিন বেশ কষ্ট পেতে হলেও এখন অনেক কিছুর সাথে মানিয়ে নিয়েছেন বলে জানিয়ে শিশু আরিফের মা বলেন, ‘প্রথমে অনেক অসুবিধা হয়েছিল। প্রথমে আমি ৩টা রোজা রাখছি খালি বিস্কুট খেয়ে। এখানে তো পানিগুলাও ঠিক না। বাইরে থেকে আনাতে হয়। প্রথম দিকে আনাতে পারতাম না। এখন ওই ভাইয়াগুলা এনে দেয়। ইফতারও ঠিকমতো পাচ্ছিলাম না। পরে ওয়ার্ডের সবাই কমপ্লেইন দিছে। এরপর এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক আছে।’

গত ১০ দিন ধরে চিকিৎসার পর আরিফ অনেকটাই সুস্থ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওর আবার একটা টেস্ট হইছে। ওটা নেগেটিভ আসছে। ডাক্তার জামাল আমাকে আজকে জিজ্ঞেস করেছেন আমি ছেলেকে এখানে রাখবো নাকি অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাবো। আমি বলেছি উনারা একেবারে সুস্থ বললে ছেলেকে নিয়ে আমি একেবারে বাড়ি যাবো। অন্য হাসপাতালে যাবো না। আমারও টেস্ট হইছে। আল্লার রহমতে আমারও নেগেটিভ আসছে। আমি আল্লার কাছে কিছু চাই না। খালি আমার ছেলে সুস্থ হই যাক।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *