ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে কবে মুক্তি মিলবে শিশুদের
বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কত তা নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে দীর্ঘদিন কোনো জরিপ হয়নি। ফলে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কত সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তবে ২০১৩ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল। তবে করোনাকালে দেশে শিশুশ্রমিক বেড়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের নতুন এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে, যা গত চার বছরে বেড়েছে ৮৪ লাখ। মহামারির কারণে ২০২২ সাল সমাপ্ত হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ৯০ লাখ শিশু শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে বাংলাদেশে বর্তমানে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কত তার সঠিক তথ্য নেই। কারণ শিশুশ্রম নিয়ে সরকারি বা না বেসরকারি পর্যায়ে দীর্ঘদিন কোনো জরিপ হয়নি।
২০১৩ সালের জাতীয় শিশুশ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী, পূর্ণকালীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো ১৭ লাখ শিশু। তাদের মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশুই নিয়োজিত ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। করোনাকালে দেশে শিশুশ্রমিক আরও বেড়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে আট বছর আগের ওই জরিপ এখন আর প্রাসঙ্গিক নয় বলে দাবি করেছেন শিশুশ্রমিক পুনর্বাসনে সংশ্লিষ্টরা। কারণ তখন যারা শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করতো তারা আর এখন শিশু নেই।
সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু জানান, ২০১৮ সালে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এক লাখ শিশু শ্রমিককে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে ২০১৯ সালে টাকা বরাদ্দ হয়। এতদিনে এটা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় এখনো ঠিকমতো মাঠেই নামতে পারেনি। সময়মতো বরাদ্দ পাওয়া গেলে এতদিনে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে আনা যেত।
ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন নান্নু অভিযোগ করেন, শিশুশ্রমিকের সংখ্যা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ না করা আসলে সরকারের একটা কৌশল। কারণ এসব নিয়ে কাজ করলে শিশুদের পুনর্বাসন করতে হবে, জিনিসগুলো আলোচনায় আসবে। এতে সরকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
সেভ দ্যা চিলড্রেন বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা ও অধিকার বিভাগের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, আমরা যখন শ্রমজীবী শিশুর কথা বলি তখন ঘুরেফিরে ২০১৩ সালের জরিপের কথাই উঠে আসে। কারণ এরপর আর জরিপ হয়নি। সেটাতে দেখা গিয়েছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এই পরিসংখ্যান আসলে এখন প্রাসঙ্গিক না দুটো কারণে। এক, আমাদের দেশের বিজনেস মডেল চেঞ্জ হয়ে গেছে, সেই অর্থনীতি আর নেই। দুই, ২০১৩ সালে এই শিশুদের বয়স ছিল গড়ে ১০ থেকে ১৪ বছর। এখন আট বছর পর তারা কেউই শিশু নেই।
তিনি আরও বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে ১৪ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা কত আছে সেটা জানা জরুরি। সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছেই এখন এ ধরনের পরিসংখ্যান নেই। তবে এটার বের করার একটা উপায় আছে। পঞ্চম শ্রেণিতে যারা পিএসসির জন্য রেজিস্ট্রেশন করছে এবং এসএসসির জন্য যারা রেজিস্ট্রেশন করছে- এই সংখ্যার পার্থক্যই হচ্ছে ঝরে যাওয়া শিশু। এই ঝরে পরা শিশুদের একটা বড় অংশ আর্থিক অসঙ্গতির কারণে শ্রমবাজারে যুক্ত হয়। তাছাড়া করোনার কারণেও অনেক শিশু পড়ালেখা ছেড়ে শ্রমক্ষেত্রে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকার মোটর গ্যারেজ, ওয়েল্ডিংয়ের কাজ বা চায়ের দোকানে দেখবেন অনেক শিশু কাজ করে। এসব শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন মেম্বারের মতো মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ তাদের এলাকার কোন ফুটপাতে কে কী করছে তারা এসব জানেন। তাদের মাধ্যমে সরকার উদ্যোগ নিলেই শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। শুধু পুনর্বাসন করে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের শিশু সুরক্ষা বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাফেজা শাহীন বলেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি প্রজেক্টের কাজ শুরু করি আমরা। আট জেলায় ৭৪ হাজার শিশু ছিল এ প্রজেক্টে। তারা সবাই কোনো না কোনো শ্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমরা তাদের কাজ ও পরিবারের তথ্য নিয়ে প্রোফাইল তৈরি করি। এদের স্কুলে ভর্তি করেছিলাম। পরে করোনার জন্য আমরা ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত অনলাইনে কাজ চালায়। করোনার কারণে শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। জুলাইয়ে আমরা টেলিফোন সার্ভে শুরু করি। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত আমরা তাদের ট্র্যাক করি।
তিনি আরও বলেন, আমরা ৭৪ হাজারের মধ্যে ৩৩ হাজার শিশু বা তার অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। এর মধ্যে প্রায় ৩৩ শতাংশ শিশু আর স্কুলে যায় না বা আর আগের এলাকায় নেই। এদের বড় অংশ আবারও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। তাদের বয়স আট থেকে ১৭ বছর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নারায়ণগঞ্জে হাশেম ফুডসের অগ্নিকাণ্ডে আমরা দেখেছি অনেক শিশু শ্রমিক পুড়ে মারা গেছে। এরা কাজের সন্ধানে বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে।
রাফেজা বলেন, ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার ওয়েলফেয়ার কমিটি আছে ৯ সদস্যবিশিষ্ট। আমরাও আছি এখানে। এখন শিশুশ্রম নিরসনের জন্য একটা ড্রাফট শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। সেটা প্রক্রিয়াধীন আছে।
ড্রপ ইন সেন্টার ফর স্ট্রিট এন্ড ওয়ার্কিং চিলড্রেনের মোহাম্মদপুর শাখার কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান দাবি করেন, আসলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কত সেটা এখন দেশে কেউ জানে না। এ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জরিপ হওয়া জরুরি।
শিশুশ্রম নিরসনের ড্রাফট জাতীয় পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহীর মোবাইলে কল ও এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।