ঘরবন্দি শিশু-কিশোরদের বাড়তি যত্ন দরকার

রাজধানীর মগবাজারে আউটার সার্কুলার রোডের একটি অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচতলায় দুই সন্তান নিয়ে থাকেন আসাদুল ইসলাম। বড় সন্তান ফাইজা নূর ইসলাম অষ্টম শ্রেণিতে আর ছোট ফাহিম নূর ইসলাম পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। গত বুধবার সকালে আসাদুল ইসলামের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, সবাই ঘরবন্দি। দুই সন্তানের মুখে নেই প্রশান্তি। বিরক্তি প্রকাশ করে ফাহিম বলে, ‘কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার! কত দিন স্কুলে যাই না! বন্ধুদের সঙ্গে মিশি না! বাইরে খেলতে যাই না!’ কিভাবে সময় কাটছে জানতে চাইলে ফাহিম বলে, ‘টিভি দেখে, বারান্দায় বসে থেকে।’ একই কথা বলল ফাইজাও।

ফাইজা, ফাহিমের মতো বর্তমানে দেশে কোটি কোটি শিশু-কিশোরের একই অবস্থা। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে বদলে গেছে পুরো দেশে শিশু-কিশোরের জীবনধারা। দুই সপ্তাহ আগেও ওরা সবাই ব্যস্ত ছিল পড়ালেখা আর খেলাধুলা নিয়ে। সকালে স্কুল-কলেজে যাওয়ার তাড়া, দুপুরে বাসায় ফিরে একটু বিশ্রাম, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, আড্ডা, হৈ-হুল্লোড়। এখন সব বন্ধ। বিশেষ এই পরিস্থিতিতে দিন-রাত ওরা ঘরবন্দি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তাদের জীবনে এই ছন্দপতন বয়ে এনেছে। ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বড়দেরও এখন থাকতে হচ্ছে ঘরের মধ্যে। এরও আগে থেকে শিশু-কিশোররা ঘরে আটকা। প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী ঘরে এখন। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থী পৌনে দুই কোটি, আর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী এক কোটির ওপর। ঘরবন্দি এই শিশু-কিশোরদের মধ্যে পড়ছে নানা নেতিবাচক প্রভাব। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার দিনগুলোতে শিশু-কিশোরদের প্রতি অভিভাবকদের বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। ঘরবন্দি এই অবস্থায় শিশু-কিশোরদের ওপর মানসিক চাপ তৈরির পাশাপাশি তাদের শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এ অবস্থায় ঘরেই শিশু-কিশোরদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তাদের মনে আনন্দ সৃষ্টি করে এমন ইনডোর খেলাধুলারও ব্যবস্থা করতে হবে।

অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি বাড়ানো এবং চলমান অচলাবস্থা নিয়ে অভিভাবকদেরও দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে রাজধানীর ইস্কাটনের বাসিন্দা আবুল হাসনাত চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী মরিয়ম চৌধুরী দুই কিশোর সন্তানকে নিয়ে বাসায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। মুঠোফোনে আবুল হাসনাত চৌধুরী বলেন, ‘চলমান অচলাবস্থায় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। বাসায় এভাবে বন্দি থাকতে থাকতে ওরা হাঁপিয়ে উঠেছে। স্কুলের পড়ালেখায়ও মন নেই। আগামী মে-জুন মাসে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা। অথচ স্কুল বন্ধ। ওদের লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হচ্ছে।’

মরিয়ম চৌধুরী বলেন, ‘আমার দুই কিশোর সন্তান একদম ঘরে থাকতে চাচ্ছে না। আবার আমরাও তাদের বাইরে বের হতে দিচ্ছি না। কবে নাগাদ পরিস্থিতির উন্নতি হবে, কেউ জানি না!’

কল্যাণপুরের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘সারা দিন ঘরে থাকতে থাকতে বাচ্চারা বিমর্ষ হয়ে গেছে। ওদের মধ্যেও একটা অজানা আতঙ্ক। বাসায় বাচ্চারা পড়ালেখা করতে চায় না। ভীষণ চিন্তায় আছি।’

করোনাভাইরাস সংক্রমণে শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর হার কম হলেও চিকিৎসকরা বলছেন, শিশু-কিশোররাও ঝুঁকিমুক্ত নয়। বড়দের পাশাপাশি ছোটদের সতর্ক ও নিরাপদ থাকার পরামর্শও দিয়েছেন তাঁরা।

উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা শামীম আহসান খান ও স্ত্রী রুনা নাহরিন স্কুলপড়ুয়া দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে ঘরেই থাকেন। মুঠোফোনে তাঁরা বলেন, ‘ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্টে আমরা থাকি। বাচ্চাদের ঘরেই রাখার চেষ্টা করি। মাঝেমধ্যে ওরা ছাদে যায়। ঘরে একদমই থাকতে চায় না। ঘরে থাকতে থাকতে ওদের ভেতর একটা বিরক্তি তৈরি হয়ে গেছে। সেটা আমরা কাটানোর চেষ্টা করি।’

কথাসাহিত্যিক ও মনোবিদ আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘করোনাভাইরাসের খবরগুলো শিশু-কিশোরদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। এ অবস্থায় তাদের বুঝিয়ে কথা বলতে হবে। ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা যাবে না। বিশেষ করে পাঁচ-ছয় বছরের শিশুদের মধ্যে ভয়ের প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। যারা মানসিকভাবে দুর্বল, তাদের মধ্যে এর প্রভাবটা বেশি।’

এ সময় শিশুদের আনন্দদায়ক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। শিশু-কিশোরদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘শহরের অধিকাংশ মা-বাবা চাকরি করেন। ব্যস্ত সময় পার করেন। ফলে সন্তানদের প্রতি তাঁদের অনেকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন না। এখন যেহেতু সব ছুটি ও বন্ধ, এ সময়টায় শিশু-কিশোদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেওয়া উচিত। তাদের সঙ্গে গল্প, আড্ডা, মজার মজার খেলা শেখানো যেতে পারে। দাবা, লুডু, ক্যারম খেলা ঘরে মানানসই। শিশু-কিশোরদের নিয়ে এসব খেলায় অংশ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি তাদের বাসার কাজ শেখানো, ঘরের জিনিসপত্র গোছানো, বারান্দার গাছগাছালির যত্ন নেওয়া শেখানো যেতে পারে। এর মাধ্যমে ওদের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। ভালো সময়ও কাটবে।’

মনোবিদ ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের ওপর যেন কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সে জন্য অভিবাভকদের বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের এ সময় কড়া শাসন না করে বুঝিয়ে বলতে হবে। শিশুতোষ বই, কিশোর গল্প-উপন্যাস পড়তে দিলে তাদের সময় ভালো কাটবে। পাশাপাশি তাদের অন্যান্য কাজে উৎসাহ দিতে হবে। সঙ্গ দিতে হবে বড়দের। শিশুদের বোঝাতে হবে, কেন তাদের বাইরে যাওয়া যাবে না।’

মনোবিদ আহমেদ হেলাল বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ ইস্যুতে বড়দের মতো শিশুরাও মানসিক চাপে ভুগতে পারে। এ সময় তারা মা-বাবাকে একটু বেশি আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। উৎকণ্ঠিত হয়, নিজেকে গুটিয়ে রাখে, অস্থির হয়। মানসিক চাপজনিত এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে তাদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে হবে, একটু বেশি সময় দিতে হবে। আর শিশুকে নিজের মতো করে ঘরোয়া খেলা খেলতে দিন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *